দিল্লী নামা-৫

Apr 10, 2024ভ্রমন0 comments

দিল্লিতে ঠিক কতদিন আমাকে থাকতে হবে সেটার কোন আন্দাজ না থাকায় আমাকে বেশ কষ্ট পেতে হয়েছে। আসার মূল উদ্দেশ্য চিকিৎসা ছিল, কিন্তু সেটা এখন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। একেতো এখানে আমার করার মত কিছু নেই, দ্বিতীয়ত আমার নিজের কাজকর্ম সব গোল্লায় যাচ্ছে। আলিনা নতুন ক্লাসে উঠেছে, কিন্তু একদিনও ক্লাস করতে পারেনি। তার মানসিক চাপ কমানোর জন্য খুব অল্পই করতে পারছি।

দিল্লী নামা-৫ 1

মাঝে খুব জরুরী কিছু কাজ সারবার জন্য আমি দিন-চারেকের জন্য ঢাকা ফেরত গিয়েছিলাম। যাবার সময় খুব একটা জিজ্ঞাসার সম্মুখীন না হলেও আসার সময় ঢাকা এবং দিল্লি দুই এয়ারপোর্টেই বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। আমার ভিসার ক্যাটাগরীর জন্য মূলত এই ঝামেলা। এবার আবারও ফেরত যাবার সময় হয়ে গিয়েছে, কিন্তু একবার গিয়ে আর ফেরত আসা যাবে কিনা সেটা নিয়ে আমার বেশ সন্দেহ আছে।

ঠিক এই কারনেই আমি মানুষের তৈরি বর্ডারের উপর আস্থা রাখতে পারিনা। আমি স্বপ্ন দেখি এমন একটা পৃথিবীর যেখানে মানুষ পাখির মত মুক্ত ভাবে উড়ে বেড়াতে পারবে। আমরা যতই সভ্য হয়েছি ততই কঠিন সব নিয়ম কানুনের বেড়াজালে নিজেদের বেঁধে ফেলেছি। কোথাও ধর্মীয় আইন, কোথাও সামাজিক আর কোথাও রাষ্ট্রীয় আইনের মারপ্যাঁচে নিজেদের বেঁধে ফেলেছি। সব কিছুই একটা পরাধীনতা। এমন না যে আইনের দরকার নেই, অবশ্যই আছে। কিন্তু সেটা যখন অতিরিক্ত নিয়ম আরোপ করে তখন তা মাথা ব্যাথার কারন হয়ে দাঁড়ায়।

আমার সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হচ্ছে সময় নষ্ট হওয়াতে। তাইতো দিল্লীর মত শহরও আমাকে টানছে না। কোথাও একটা সুর কেটে গেছে। বড্ড বেশি বাসার জন্য মন টানছে। এতটা হোমসিক নিজেকে কখনও মনে হয়নি।

এদেশের মেডিক্যাল এজেন্ট, যাদের আমরা দালাল বলি, মূলত এরাই এই ঝামেলার জন্য দায়ী। এদের উপর নির্ভর করাটা কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদেশ বিভূঁইয়ে যারা বছরের পর বছর পড়ে থাকেন, তাদের লাল সালাম।

এই কিস্তির পাঁচ নম্বর পর্বও আমি লিখতে চাইনি। ভেবেছিলাম দিল্লী নামার চার নম্বর পর্বের পরেই আমি নিজ দেশে ফেরত গিয়ে শান্তিতে আমার অভিজ্ঞতা নিয়ে একটা পডকাস্ট করব। সেটাও হয়নি। অভিজ্ঞতা বিষাদে আর হতাশায় পরিনত হয়েছে।

কাগজপত্র জালিয়াতি করার কারনে নেপালী আর বাংলাদেশী একদল লোক ধরা পড়েছে। সেই সূত্রে হরিয়ানা পুলিশ ইনভেস্টিগেশন করে বিশাল বড় একটা একটা চক্রের সন্ধান পেয়েছে যারা এই কাজের সাথে জড়িত। ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকারে চাপে তাই সব হাসপাতালের বোর্ড মিটিং বন্ধ। আমাদের অনিশ্চিত যাত্রা আরো প্রলম্বিত হয়ে গেলো।

মারফি’স ল ঠিক এই কথাটাই বলে, যদি কিছু খারাপ ঘটার সম্ভাবনা থাকে, তবে তা ঘটবেই এবং সেটা সবচেয়ে খারাপ সময়েই ঘটবে। আমি এই দেশীয় দালালদের খপ্পরে না পড়লে হয়ত চিকিৎসা কার্যক্রম শেষ করে আরো মাস দুয়েক আগেই ঢাকা চলে যেতে পারতাম।

আগামীকাল ঈদ, আমি ক্ষুনাক্ষরেও ভাবিনি ঈদ আমাকে ভারতে কাটাতে হবে।

এদের এখানে হোলি দেখলাম, সেটা আমার একটুও ভালো লাগেনি। ছেলেবুড়ো সবাই বাসার উপর থেকে রাস্তা দিয়ে যাওয়া মানুষের গায়ে পানি আর রঙ ভরা বেলুন ছুড়ে মারছে। সেদিন আমাকে একটা দরকার বাংলাদেশ এম্বেসিতে যেতে হয়েছিল। ভয়ে ছিলাম কখন না গায়ের উপর পানি বোমা পড়ে। যদিও শেষ পর্যন্ত এরকম কিছুর সম্মুখীন হতে হয়নি।

আমি জাসোলাতে আছি, এটার পাশেই শাহীনবাগ, মুসলিম এরিয়া। ঈদের আমেজ ওইদিকেই থাকার কথা। দেশে থাকতে ঈদ নিয়ে কখনও মাথা ঘামাইনি। কি আশ্চর্য, এবার সেটাকেও কেনো জানি খুব মিস করছি।

অনেকদিন পর লিখতে বসে আসলে কিছুটা ভালো লাগছে। আমার লেখা খুব কম লোকেই পড়ে। একারনেই যা খুশি লিখতে পারি। আর সোশ্যাল মিডিয়ার বদলে মানুষ এখন আর ব্লগে এসে লেখা পড়েনা বললেই চলে। এটাও একদিক থেকে ভালো হয়েছে। খুব বেশি খারাপ লাগলে রাতের বেলা বন্ধুর সাথে কথা বলি। কিছুটা মানসিক চাপ কমে।

দিল্লীতে অবশেষে আমি একটা মন্দের ভালো বিরিয়ানির দোকান খুঁজে পেয়েছি। এদের খাবার মোটামুটি মুখে দেয়া যায়। মাঝে মাঝেই জোমাটোতে (Zomato) অর্ডার করি। অনেকটা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মত।

দিল্লী নামা-৫ 2

দিল্লীতে থাকতে থাকতে যে জিনিসটা আমার খুব বেশি চোখে লেগেছে সেটা হচ্ছে এদের ট্রাফিক সেন্স। এরা ট্রাফিক খুব কড়াভাবে মেনে চলে। যেটা আমাদের দেশের লোকের নাই বললেই চলে। হুটহাট লেন পরিবর্তন করা কিংবা স্পিডে গাড়ি চালাতে খুব কম লোককেই দেখেছি এখানে। মোটরসাইকেল ওয়ালারা আমাদের দেশের থেকে কিছুটা ভদ্র, তবে চারচাকা খুব নিয়ম মেনে চলে। আমি উবারের উপর খুব নির্ভরশীল এখানে। মোবাইলে উবার ভাড়া করে যেকোন জায়গায় চলে যাওয়া যায় অনায়াসে, যেটা ঢাকায় আশা করাটা বাতুলতা।

পুরুষ মানুষের বেঁচে থাকার অর্থ হচ্ছে কিছু একটা করা। সেটাই আমি পারছিনা এখানে থেকে। খুব দেশে চলে যেতে ইচ্ছে করছে। ঢাকার ট্রাফিক জ্যামটাকেও এখানে থেকে বেশ আপন বলে মনে হচ্ছে। জানিনা ভবিষ্যত ঠিক কি পরিকল্পনা নিয়ে অপেক্ষা করছে!

দিল্লী নামা-৫ 3
এই জিনিস্টার নাম হালিম। কোনভাবেই আমাদের ঢাকার হালিমের মত ভালো না। ডিসেন্টের হালিমের মত মাংস পিষে দেয়া হলেও এতে বাদাম আর লেবু দিয়ে পুরা জিনিসটাকে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে।

আমি যে খাবারটাকে পুরী বলে জানি, সেটাকে এরা বলে কাচুরী। সাথে একটু টক হয়ে যাওয়া আলুর তরকারি দেয়। ভেতরে ডাল দিয়ে ঠাসা থাকে অনেকগুলোতে। মোটামুটি ভাবে দুটো খেলেই পেট ভরে যায়।

দিল্লী নামা-৫ 4

এরা আমাদের সিংগাড়াকে বলে সামোসা, আর আমাদের দেশী সমোসার কোন অস্তিত্ব আমি এদেশে এখনো খুঁজে পাইনি।

0 Comments

মন্তব্য

দেলোয়ার জাহান

মনের একান্তে কিছু কথা থাকে যা কাউকে বলা যায় না। বলতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খায় আমাকে। সে সকল হাবিজাবি জীবন দর্শন আর কিছু অসময়ের কাব্য নিয়ে আমার লেখালেখির ভুবন।

Pin It on Pinterest

Share This