ভ্রমন

Mar 11, 2024গল্প, সাহিত্য0 comments

২০৫৫ সাল

মানুষের পৃথিবীর একটা সভাকক্ষ। সভায় উপস্থিত আছেন প্রায় জনা বিশেক লোক। এদের কাপড়চোপড় আর চেহারা দেখলেই যে কেউ হুট করে বুঝতে পারবে এরা খুব গুরুত্বপূর্ণ কেউ।

সভাপতি হিসেবে আছেন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের মূল সদস্য আমেরিকার প্রতিনিধি জন ভিক্টর। প্রেসিডেন্টের আজ থাকার কথা থাকলেও তিনি নেই। 

রাশিয়ান প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আন্দ্রে বোরিস বেশ অনেকক্ষন থেকে কিছু বলার জন্য উসখুস করছেন, কিন্তু সুবিধা করতে পারছেন না।

সবাই সভাপতির দিকে তাঁকিয়ে আছে। তিনি আরামসে বার্গারে কামড় বসাচ্ছেন।

ফ্রান্সের প্রতিনিধি মার্কেল মুলার মুখ খুললেন।

– এই জরুরী সভা ডাকার কারন কি? আর ডেকে এনে আধা ঘন্টা বসিয়ে রাখার মানেটা কি?

হাতের  আধ-খাওয়া বার্গার নামিয়ে রেখে জন মুখ খুললেন।

– দরকার আছে। জরুরী দেখেই আমরা এখানে একসাথে বসেছি। আমি ডিনার পর্যন্ত করতে পারিনি। একা একা বার্গার খাবার জন্য দুঃখিত। আপনি খাবেন?

– এটা মশকরা করার সময় নয় ভিক্টর। বোরিস বিরক্ত কন্ঠে বললেন। আমাদের সবার অনেক কাজ আছে। সেগুলো ফেলে এই রাত এখানে বসে থাকার কোন মানে দেখছি না।

জন ভিক্টর বোরিসের দিকে তাঁকিয়ে চোখ টিপে দিলেন।

– আমাকে জন বলেই ডেকো বোরিস। আর তোমার গুরুত্বপুর্ন কাজ মানে তো গার্লফ্রেন্ডের কাছে যাওয়া তাই না? আজকে না হয় বাসায় গিয়ে নিজের বউকে একটু সময় দিও।

বোরিসের কান লাল হয়ে গেল কথা শুনে। রেগেমেগে কিছু বলার আগেই জাপানিজ এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে গেলেন তার চেয়ার ছেড়ে। কেতাদুরুস্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে বাও করলেন সবাইকে। চমৎকার চোস্ত ইংরেজীতে বলা শুরু করলেন।

– আমার মনে হয় আমরা এখানে ব্যাক্তিগত আক্রমন করতে আসিনি একে অন্যকে। পৃথিবীর কোন বিপদ হলে তা একসাথে মোকাবেলা করার জন্যই এই কমিটি গঠন করা হয়েছিল। আমাদের আমেরিকান বন্ধু কি বলতে পারবেন আসন্ন কি বিপদের আশংকা তিনি করছেন?

সভাকক্ষের পরিবেশ কিছুটা নিরব হলো। সবাই তাকিয়ে আছে এখন জনের দিকে। জন বার্গারে শেষ কামড় বসালেন। একটা বড় ঢোক গিলে শুরু করলেন।

– আমাদের জাপানিজ বন্ধু আসলে অনেক কিছুই জানেন।

জাপানিজ ভদ্রলোক মৃদু হাসলেন, কিন্তু কিছু বললেন না। জন আবার শুরু করলেন।

– আমরা গত মাসে ত্রিশ জন মানুষকে প্রথমবারের মত স্পেসে পাঠিয়েছিলাম। মঙ্গলে আমাদের নতুন “ইন্টারন্যাশনাল কলোনী অব হিউম্যান” পরিদর্শনের জন্য। তারা গত সপ্তাহে ফিরে এসেছেন পৃথিবীতে।

– সেটা আমরা সবাই জানি। বোরিস মৃদু স্বরে বললেন। “সবাই কোয়ারেন্টাইনে আছেন।”

– ঠিক, কিন্তু কিঞ্চিত সমস্যা হয়েছে সেখানে। এটাই আমাদের জন্য উদ্বেগজনক।

– কি ধরনের সমস্যার কথা বলছেন আপনি? জার্মান ভাইস চ্যান্সেলর জানতে চাইলেন।

একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে জন আবার বলা শুরু করলেন।

– তাদের অনেকেরই মানসিক বৈকল্য দেখা দিয়েছে। আমাদের ডাক্তারেরা তাদের এখনও চিকিৎসা দেবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু কোনভাবেই আর তারা সুস্থ নাও হতে পারেন বলে জানিয়েছেন। 

সভায় কিছুটা গুঞ্জন শুরু হয়ে গেলো। এমন না যে এর আগে কেউ মঙ্গলে যায়নি। অন্তত জনা ত্রিশেক মানুষ মঙ্গলে এখন বসবাস করছে। এক হাজারের মত সায়েন্টিস্ট আর ডাক্তার গত পাঁচ বছরে ঘুরে এসেছেন আর এখনও যাচ্ছেন সেখানে। তাদের যদি কোন সমস্যা না হয়ে থাকে তবে এদের কি হলো?

– আসলে এবার আমরা যাদের পাঠিয়েছিলাম, তাদের মধ্যে আমেরিকান, চায়নিজ, রাশিয়ান, জার্মান আর অল্প কিছু এশিয়ান লোকজন ছিলেন। এরা বেশিরভাগই রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব, বড় ব্যবসায়ী, ধর্ম-প্রচারক, সাহিত্যিক অথবা সমাজের নানা স্তরের প্রভাবশালী লোকজন।

– তাতে সমস্যাটা কি হয়েছে? এমন না যে এবারই প্রথম মানুষ মঙ্গলে যাচ্ছে? বোরিসের কন্ঠে মৃদু তাচ্ছিল্য। 

– সমস্যা হচ্ছে এরা কেউই বিজ্ঞানী বা যৌক্তিক মানুষ ছিলেন না। পৃথিবীতে তারা বড় ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক কিংবা ধর্ম প্রচারক ছিলেন। এদের মঙ্গলে পাঠানোর উদ্দেশ্য ছিল আমাদের স্পেস মিশনগুলোর জন্য আরো বেশি বাজেট জোগাড় করা। কিন্তু ফিরে আসার পর তারা আর আগের মত নেই?

– কিরকম একটু যদি ব্যাখ্যা করেন?

জনকে এবার অল্প হাসতে দেখা গেলো-

– ফিরে আসার পর তারা আর সেই আগের মানুষ নেই। আমাদের সাইকিয়াট্রিষ্টরা বলছেন এদের মানসিকতা পুরোপুরি বদলে গেছে। তারা নাকি স্পেস শাটলে থেকে যখন পৃথিবী দেখেছেন, তখন বলাবলি করছিলেন, এই ক্ষুদ্র একটা বিন্দুর জন্য মানুষ এত লড়াই করছে? এত অহংকার আর জাতিতে জাতিতে মারামারি সব নাকি বৃথা। তারা শপথ নিয়েছেন কোন ধরনের অনৈতিক কাজে আর তারা জড়াবেন না।

– তো… এটাতো অনেক মহৎ চিন্তা। এরকমটা হলে সবাইকে একবার করে হলেও মহাশুন্যে পাঠানো দরকার। জাপানী ভদ্রলোক মৃদুস্বরে সায় জানিয়ে বললেন।

জন হাসিমুখে সবার দিকে একবার তাঁকালেন। তারপর আবার বললেন।

– এদের বেশিরভাগই এখন আর নিজেকে কোন দেশের বলে দাবি করতে চাইছেন না। বেশ কয়েকজন ধর্ম ত্যাগ করেছেন। দুজন সাহিত্যিক কৃষিকাজে যোগ দেবেন বলে জানিয়েছেন। আর আমাদের দশজন সিনেটর এবং দুজন বড় ব্যবসায়ী জানিয়েছেন যে কোন ভাবেই হোক পৃথিবী থেকে বর্ডারের ধারনা সরাতে হবে। সবাই একই পৃথিবীর মানুষ।

সভার গুঞ্জন এবার কিছুটা বাড়ল। মনে হয় সবাই বুঝতে পারছে ঘটনা কোনদিকে যাচ্ছে। 

যে ত্রিশজন মানুষকে প্রথমবারের মত আন্তর্জাতিক স্পেস সেন্টারে পাঠানো হয়েছিল টুরিস্ট হিসেবে, তারা সবাই পৃথিবীতে বেশ ক্ষমতাশালি লোক। কারো অস্ত্রের ব্যবসা আছে, কেউ ধনকুবের, আবার কেউ টেক জায়ান্ট বা মিডিয়া মুঘল। মোটামুটিভাবে এরাই পৃথিবীর রাজনীতি আর ব্যবসা নিয়ন্ত্রন করে। এরা যদি এরকম বিপদজনক কাজ শুরু করে তবে সামনে মহাবিপদ। পুরো পৃথিবীজুড়ে একটা যুদ্ধ লেগে যাওয়াও অসম্ভব নয়।

– আমাদের করনীয় কি এখন?

– সেটা সবাই মিলে ঠিক করেন। এরা যদি এখন নিজেদের উদার মনোভাব দেখানো শুরু করেন কোয়রেন্টাইন থেকে বের হয়ে, তবে অস্ত্রের ব্যবসা, মিডিয়ার ব্যবসা আর মেডিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি পুরো ধ্বংস হয়ে যাবে। জন কিছুটা হাঁপ ছেড়ে বাঁচে সবাইকে বোঝাতে পেরে।

জার্মান প্রতিনিধি সবাইকে হাত তুলে থামালেন।

– তাদের উদ্দেশ্য মহৎ, এতে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু সমাজে যদি ধনী-গরীব ভেদাভেদ না থাকে, রোগ-শোক না থাকে তবে অনেক ব্যবসাই নির্মূল হয়ে যাবে। যোগান এবং চাহিদার সামঞ্জস্য থাকতে হবে। বিশেষ করে বর্ডার না থাকলে মুদ্রারও কোন দাম থাকবে না। পৃথিবী জুড়ে একটা নৈরাজ্যের সৃষ্টি হতে পারে। আর জার্মানরাই সেরা জাতি, আমরা কখনই চাই না সবাই সমান হয়ে যাক।

– এহ… আসছে আমার সেরা জাতি… দুইবারের মাইরের কথা ভুলে গেছো? বোরিস টিপ্পনি কাটে।

জার্মান ভদ্রলোক বোরিসের কথায় কান দিলেন না। তিনি বলে চলেছেন।

– আর যুদ্ধ বন্ধ হয়ে গেলে আমাদের কোন সমস্যা নাই। আমরা এখন শান্তিপ্রিয় একটা জাতি। সমস্যা আমেরিকানদের। তাদের সব মোড়লগিরি বন্ধ হয়ে যাবে।

– তুমি বেশি কথা বলো মক্কেল…। জন চাপা স্বরে বলে।

– মক্কেল না … মাইকেল। নাম ঠিক করে বলো জন।

– যেই বালই হও। উপায় বাতলাও। সবার ব্যবসাই বন্ধ হয়ে যাবে।

চাইনিজ প্রতিনিধি এবার হাত তুলে বললেন, “ আমি ভেটো দিলাম।”

– ধুর বাল, এটা কি জাতিসংঘের বৈঠক হচ্ছে। এখানে ভেটো কোত্থেকে আসবে। কিছু না বলার থাকলে। চুপ করে থাকো। তোমাদের চায়নীজ টাইকুনও আছেন নতুন মানবতাবাদীদের দলে। বের হলেই বুঝবে কত ধানে কত ভুট্টা।

– চায়না ভয় পায় না। দরকার হলে গুম করে ফেলব।

– পারবাতো ঐ এক কচুই। কয়জনরে গুম করবা? এরা কেউ সাধারন টুরিস্ট না যে গুম করলেই সব চুপ হয়ে যাবে।

– ব্যবসার দরকারে তোমরাতো প্রেসিন্ডেন্টও খেয়ে দিসিলা… ভারতীয় এক ভদ্রলোক এবার টিপ্পনী কাটে। দরকার হলে আরও কয়েকজন খেয়ে দিবা।

– ভাইরে, পারলে তাই করতাম। কিন্তু এরা সহী সালামতে ফিরে আসছে এটা সবাই দেখছে। আর এরাই পৃথিবীর মা-বাপ। এটা তুমিও জানো আমিও জানি। এদের ধামাচাপা দেয়া সোজা না।

সভায় বেশ একটা গন্ডগোল লেগে গেছে। জাপানী ভদ্রলোক অবশ্য কিছু বলছেন না। তিনি মৃদু মৃদু হাসছেন শুধু।

২০৮০ সাল – 

পৃথিবীর একটা বেশ পরিবর্তন হয়েছে। বেশিরভাগ রোগের টিকা আবিষ্কার হয়ে গেছে আর মোটামুটি বিনামূল্যেই পৃথিবীর মানুষজন সেই টিকা পেতে পারে। তবে শর্ত হচ্ছে তাকে একবার হলেও মহাশূন্যে ভ্রমন করা থাকতে হবে। ক্যান্সার বা এইডস এর মত টিকা খুবই সাধারন। যে কোন অংগ প্রতিস্থাপন কৃত্তিমভাবে করা যায় এখন।

খাবারের কোন অভাব না হলেও কোন পরিবারই একটার বেশি সন্তান নিতে চায় না সহজে। কারন দ্বিতীয় সন্তান নিলে পরিবারের কর্তাকে এক বছর বাধ্যতামূলক ভাবে পৃথিবীর বাইরে চাঁদে অথবা মঙ্গলে গিয়ে কাজ করতে হয়। মানুষের বিশাল বড় বড় কলোনি গড়ে উঠেছে সেখানে। স্পেস ট্যুরিজম এর রমরমা ব্যবসা।

আশে পাশের এস্টেরয়েড থেকেও মাইনিং করে খনিজ আহরণ করতে পারে মানুষ এখন। চেষ্টা চলছে জুপিটারের দিকে যাবার। সেখানকার একটা চাঁদে নাকি কলোনি বানানোর মত রসদ আছে।

আর যুদ্ধ… নেই বললেই চলে…পৃথিবীজুড়ে একক একটা ইলেক্ট্রনিক কারেন্সি আছে। সব দেশের ব্যাংকগুলো মিলে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এর সাহায্যে এটা নিয়ন্ত্রন করে।

পৃথিবীর অনেক দেশেই এখন আর বর্ডার নেই। সবাই বর্ডার থেকে তাদের সৈন্য আর চেকপোস্ট প্রত্যাহার করে নিয়েছে। মানুষের জন্মের সময়ই সবাইকে একটা চিপ দিয়ে দেয়া হয় শরীরের ভেতর, তাতেই তার পরিচয় থাকে। সে যেখানে খুশি ভ্রমন করতে পারে, যে কোন পেশায় যোগ দিতে পারে যোগ্যতা অনুযায়ী। তাকে বাধা দেবার কেউ নেই।

0 Comments

মন্তব্য

দেলোয়ার জাহান

মনের একান্তে কিছু কথা থাকে যা কাউকে বলা যায় না। বলতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খায় আমাকে। সে সকল হাবিজাবি জীবন দর্শন আর কিছু অসময়ের কাব্য নিয়ে আমার লেখালেখির ভুবন।

Pin It on Pinterest

Share This