আলিনা অধ্যায় ২১: এই মেঘ, এই রোদ্দুর

May 20, 2024আত্মকথন, সাহিত্য0 comments

দীর্ঘ খরতাপের পর কাল মাঝ রাত্তিরে একটু বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টির জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষায় থাকা ঢাকাবাসীর জন্য সুখবর। বৃষ্টির আশায় বিশেষ নামাজ হয়েছে, ব্যাঙের বিয়ে হয়েছে – ইত্যাদি। কিন্তু প্রকৃতি রুষ্ট ছিলো। অবশেষে ধরনী শীতল করে ঝুম বৃষ্টি নেমেছে।

এটা আমাদের জন্য একটা শিক্ষার মত। আমরা যতই আধুনিক হই, আমাদের জীবন এখনও নিয়ন্ত্রন করে প্রকৃতি। শহরটাকে আধুনিক বানানোর নামে অপরিকল্পিত ভাবে আমরা যখন এর ব্যবচ্ছেদ করছি, সে তার নিজস্ব নিয়মে প্রতিরোধ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। বাড়িয়ে তুলছে তাপমাত্রা। অনেকটা শরীরের জীবাণু মারার জন্য আমাদের জ্বর হয় যেরকম করে , সেরকম। একসময় আমাদের বেঁচে থাকা কঠিন থেকে কঠিনতর করে তুলবে তার নিজস্ব নিয়মে। আমাদের করার কিছুই থাকবে না। আমরা আরো অনেক প্রজাতির মত নিজেদের ব্যার্থতায় নিঃশ্চিহ্ন হয়ে যাবো।

আমি সবসময় একটা কথা বলি, প্রকৃতি কখনও ব্যাক্তির উপর প্রতিশোধ নেয় না, সে প্রজাতির উপর শোধ নেয়।

আলিনার বৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা আর উৎসাহ মনে হয় আমার কাছ থেকে পাওয়া। রাত বারোটাতেও তাই সে আমার সাথে বারান্দায় গিয়ে বৃষ্টির ফোটা হাত বাড়িয়ে ধরতে চায়। আমাকে জিজ্ঞেস করে, বৃষ্টির পানি কি খাওয়া যাবে? আমি মানা করলে জানতে চায়, বজ্রপাতের সময় এত শব্দ আর আলো হয় কেনো?

আমি আমার সীমিত জ্ঞানে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি। মনেপ্রানে চাই, তার এই সারল্য আর জিজ্ঞাসু মন টিকে থাকুক জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।

রাতে বৃষ্টি বিলাসের জন্য দেরি করে ঘুমানোর কারনে সকালে উঠতে তার কষ্ট হয়। স্কুলের দেরি হয়ে যায়। অবধারিত ভাবে মায়ের বকুনি। যদিও দোষটা আমার! কিন্তু তারপরেও আমি চাই একজন মানুষ বৃষ্টি ভালোবাসুক। জীবন তাকে জটিল আর কুটিল করে তোলার আগে সে কিছুটা আনন্দের শৈশব স্মৃতি জমা রাখুক নিউরনে।

আমরা মানুষ হিসেবে খুব অল্প সময় টিকে থাকি পৃথিবীর বুকে এর মাঝে যতটা সময় পারা যায় আনন্দে থাকা উচিৎ। অন্তত আমার ব্যক্তিগত দর্শন তাই। জীবন নানাভাবে তোমাকে পিষে ফেলতে চাইবে, তোমার কাজ হচ্ছে যতবার পড়ে যাবে, উঠে দাঁড়ানোড় চেষ্টা করা। বেশিরভাগ মানুষই সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারে না, কারন সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠার জন্য তাদের কোন অনুপ্রেরনা নেই।

সুন্দর আর স্বাধীনতাকে ভালোবাসলে এইরকম অনুপ্রেরণা পাওয়াটা সহজ হয়। কিছু সুখের স্মৃতি বেঁচে থাকতে সাহায্য করবে তোমাকে।

ও বলতেই ভূলে গেছিলাম, আলিনা আবার তার স্কুলে যেতে পারছে। আমরা নিজের পাখির বাসায় আবার ফিরে এসেছি। দেশের বাইরে বেশ কয়েকমাস থেকে আসার পর, এই শহরের ধুলোবালি আর জানজটও ভালো লাগছিল।

আলিনা অধ্যায় ২১: এই মেঘ, এই রোদ্দুর 1

আমার সবথেকে ভালো লাগছে মেয়েটা আবার তার পরিচিত জীবনে আর স্কুলের সবুজ মাঠে ফিরে যেতে পারছে। বন্দিদশা থেকে তার মুক্তি মিলেছে। আমাদের পরিচিত রিকশা, রাস্তা আর ধুলোবালির শহরে স্বাগতম। নিজের চেয়ার টেবিল আর বিছানা যেন খুব পরিচিত গন্ধ নিয়ে ডাকছিলো।

পরিচিত মুখগুলো দেখা আর এই বাতাসে নিঃশ্বাস নেবার অনুভূতি স্বর্গীয়। লম্বা সময় ধরে আমি নিজেও লেখালেখি থেকে দূরে। সেটাও আবার শুরু করতে পারছি। যদিও জানি কাজে ফিরতে আরো লম্বা সময় লাগবে তারপরেও এই আবেগ অন্যরকম।

——-

নিউ মার্কেট গেলাম, সেখানে একটা জুয়েলারি দোকানে সাইনবোর্ডে লেখা, – Your Beauty is Our Happiness. আলিনা সেটা দেখে আমাকে বলল, দেখ বাবা এরা কি লিখেছে! তার মানে আমি যদি আগলি হই তবে ওরা খুশি হবে না?

আমি হাসি চেপে রেখে বললাম, ওরা আসলে বোঝাতে চেয়েছে গহনা পরলে তোমাকে সুন্দর দেখাবে আর তাতে ওরা খুশি হবে।

আলিনাকে অবশ্য তাতে “কনভিন্সড” মনে হোল না। সে শুধু ছোট্ট করে বলল, ওরা রেসিস্ট

আরেকদিন সে একটা জুসের প্যাকেট নিয়ে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করছে, দেখো বাবা, এইখানে লেখা – This may contain Milk & Chocolate powder. – এর মানে কি ওরা জানে না, এখানে কি আছে? ওরা নিজেদের জুসে কি আছে সেটাও ঠিকমত জানে না, অনুমান করতে হয়?

আমি ওর ভাষার দক্ষতায় চমৎকৃত হবো, না হাসবো ঠিক বুঝতে পারলাম না। বললাম, এরা মনে হয় একই প্যাকেজিং আরো কয়েকটা জুসের জন্য ব্যবহার করে তাই এরকম লিখে রেখেছে।

আমি ঠিক জানি না কোথা থেকে সে এইরকম চমৎকার যুক্তি শিখছে। বাচ্চাদের শেখার সবথেকে বড় জায়গা এখন বোধহয় ইউটিউব। গুগল মানব সভ্যতার ইতিহাসে সবথেকে বড় শিক্ষক হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। টেকনোলজির সুবিধা এখানেই। পৃথিবীর এক প্রান্তের জ্ঞান-বিজ্ঞান অন্যপ্রান্তে পৌছতে মিনিটেরও কম সময় লাগে। আপনি তাকে গ্রহন করলেন, নাকি করলেন না, তাতে কিছু যায় আসে না।

আমাদের দরকার বাচ্চাদের যুক্তি শেখানো। যাতে একটা সময় গিয়ে তারা জীবনের কঠিন সিদ্ধান্ত গুলো নিতে আবেগের পরিবর্তে যুক্তির স্মরণ নেয়। যুক্তি আপনাকে হারতে দেবে না। মানুষ হিসেবে যতবারই পড়ে যাবেন, যুক্তি আপনাকে ততবারই পেছন থেকে তুলে ধরার চেষ্টা করবে।

জীবন হোক যুক্তিময়।

0 Comments

মন্তব্য

দেলোয়ার জাহান

মনের একান্তে কিছু কথা থাকে যা কাউকে বলা যায় না। বলতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খায় আমাকে। সে সকল হাবিজাবি জীবন দর্শন আর কিছু অসময়ের কাব্য নিয়ে আমার লেখালেখির ভুবন।

Pin It on Pinterest

Share This