দিল্লী নামা-১

Jan 3, 2024ভ্রমন0 comments

আমার ঘুরতেই বেশি ভালো লাগে। কাঁধে একটা ব্যাগ নিয়ে যদি হারিয়ে যেতে পারতাম আমার পরিচিত শহর থেকে দূরে, এই সীমাহীন মূর্খ আর গোয়ার্তুমির লোকালয় থেকে, তবে বেশ আরাম পেতাম। গন্তব্যের থেকে যাত্রাপথের সৌন্দর্যই আমাকে সবসময় টানে। যে কারনে রেলস্টেশন বা এয়ারপোর্ট আমার খুব বেশি পছন্দের।

আমি এখন আছি দিল্লীতে, ভারতের রাজধানীতে। না, এবারের ভ্রমনটা স্বেছায় বা আনন্দভ্রমন নয়। চিকিৎসার প্রয়োজনে।

আমি সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করি বোকা মানুষজন। এরা জীবনের দীর্ঘ একটা সময় শরীরের অযত্ন করে এবং, একটা বয়সে গিয়ে যখন নানা জটিলতায় আক্রান্ত হয় তখন খুব অবাক হবার ভান করে বলে, আমার এরকম হচ্ছে কেন? তখন শুধু নিজের নয়, অন্যেরও সময়, অর্থ এবং মানসিক শান্তির অপচয় ঘটে।

এরকম বোকা মানুষজন নিয়ে ভ্রমনটা আসলে শাস্তির মত হয়ে যায়। এরা যুক্তির থেকে হোমিওপ্যাথি, পানিপড়া এবং কানপড়ায় বেশি বিশ্বাস করে।

জীবনের মধ্যভাগে এসে আমি বুঝতে শিখে গেছি বাঁচার জন্য স্বার্থপর হতে হয়। নিজের আবেগ অন্যকে দেখানো মাত্রই সে এটাকে তোমার দূর্বলতা বলে ভেবে নেবে। তোমার খুব কাছের মানুষেরাই এটা করবে।

তাই ভালো থাকার জন্য তোমাকে দেরি হয়ে যাবার আগেই “না” বলা শিখতে হবে। এই না বলতে না পারলে আজীবন তুমি পস্তাবে।

এই পটভূমি লেখার কারন আমি এবার দিল্লী আসতে চাইনি, অন্তত এই অসময়ে। খানিকটা বাধ্য হয়েই এসেছি।

আলিনার অবশ্য কোন অসুবিধা হচ্ছে না। যেখানে যাক, মা সাথে থাকলেই খুশি। আমার থেকে এবারের এয়ার জার্নিটা বেশি সে উপভোগ করেছে।

—-

দিল্লী থেকে জাসোলা গ্রাম

দিল্লী এসে কেমন যেন খেই হারিয়ে ফেললাম। মধ্যযুগের মুসলিম শাসকেরা ভারতবর্ষের উপর ছড়ি ঘুরিয়েছেন এই দিল্লীর মসনদে বসেই। বর্তমান ভারতও দিল্লীকেন্দ্রিক। কিন্তু আমি মূল শহর থেকে বেশ অনেকটা দূরে জাসোলা নামের একটা গ্রামে আছি।

জাসোলাকে গুগল ম্যাপ গ্রামই বলে। যদিও আমাদের ঢাকা শহর থেকে অনেক বেশি সুবিধা পাওয়া যায় এখানে। এপোলোর মত হস্পিটালের শাখা আছে এখানে। জায়গাটা দিল্লী আর উত্তর প্রদেশের বর্ডারের কাছাকাছি।

যে হোটেলে এসে উঠেছি সেটার নাম রাম প্যালেস। এখানে হোটেল রুমেই রান্নাবান্না করে খাবার ব্যবস্থা রয়েছে। যারা রোগী নিয়ে আসেন তারা সাধারনত বেশ লম্বা একটা সময় এখানে থাকেন। এর থেকে কমে আশে পাশে থাকার জায়গা খুব একটা নেই বলেই বোধহয়।

দিল্লী নামা-১ 1

শুধু বাংলাদেশ থেকেই নয়, বরং পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে কম স্বচ্ছল লোকেরা ভারতবর্ষে ছূটে আসেন স্বল্পখরচে চিকিৎসার জন্য। কারন চিকিৎসা বিজ্ঞানে ভারত বর্তমানে আমেরিকার সাথে পাল্লা দেয়। 

এখানাকার খাবার দাবার দেখতে বেশ মজাদার হলেও, খেতে খুব একটা ভালো লাগে না। সব খাবারেই কেমন যেন একটা লাল রঙ। দিন শেষে সেটা যেভাবে পেটে ঢোকে সেভাবেই আবার বেরিয়ে যায়। মাঝখান থেকে আতংকিত হতে হয় খাদককে।

একটা ছোট গ্যাস সিলিন্ডার আনিয়ে নিয়েছি হোটেল রুমে। রান্নাবান্না এখন সেখানেই হচ্ছে। আমার বউ আর শাশুড়ী মিলে সেখানে তিনবেলা রাঁধছেন। যদিও জানিনা এই বন্দোবস্ত ঠিক কতদিন চালানো যাবে। 

এই হোটেল থেকে সটকে পড়তে হবে খুব তাড়াতাড়ি, এখান আলিনার সময় কাটানোটাও দুস্কর।

দিল্লী নামা-১ 2
এই ভদ্রলোকএকটা চায়ের দোকান চালান জাসোলার এখানে। আমার হোটেলটার সাথেই। জামাই বউ মিলে সেখানে রান্না-বান্নাও করেন। দরকার মত অর্ডার করলে যে কাউকেই বাঙ্গালী খাবার তৈরি করে দেন।

জাসোলা গ্রাম হলেও এখানে ফুড ডেলিভারি সিস্টেম বেশ অসাধারন। জোমাটোতে অর্ডার দিলে একদম হোটেল রুমে এসে পৌছে দিয়ে যায়। আশে পাশে যে দুটো তিনটে দোকান আছে সেগুলোতে খাবারের দাম বেশ চড়া।

আরেকটু ভালো খেতে হলে পাশেই শাহীনবাগের বাজারে যেতে হবে। এখানে হেন জিনিস নেই পাওয়া যায় না। মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায়, মাছ, মাংস থেকে শুরু করে সবই পাওয়া যায়। জায়গাটা অনেকটা আমাদের চকবাজারের পাশে মৌলভি বাজারের মত।

—-

আমাদের হসপিটালে আমাদেরকে সাহায্য করছেন ওবায়েদ ভাই। তার কাজই এই মেডিক্যাল টুরিজম নিয়ে। তার এক কর্মচারী আছে শাহরুখ, সে এসে আমাদের সাথে হাসপাতালে যায়। নিজেকে সে মৌলভি দাবী করলেও আমার মনে হয়েছে সে বেশ ধুরন্দর প্রজাতির লোক। শুধু মাত্র সাহসের অভাবেই অনেক কিছু করতে পারছে না। 

তবে খুব বেশি দরকার না হলে আমি তাকে ঘাঁটাই না। একা একা কোথাও গেলে আমি সাধারনত এলাকার দালাল জাতীয় লোকজনের থেকে দূরে থাকি। এরা কাজের থেকে আকাজই করে বেশি। তবে এবারের কথা আলাদা। অনেকটা বাধ্য হয়েই যেহেতু দিল্লী আসা, তাই মেনে নিতে হচ্ছে অনেক কিছু।

বোকার সাথে থাকলে আপনাকেও বোকামি প্রশ্রয় দিতে হবে। মাঝে মাঝে নিজের ক্ষতি করে হলেও। আমি অন্যের দেখাদেখি কোন কিছু করতে যাইনা। সবসময় নিজের রাস্তা খুঁজে নিতে অভ্যস্ত। কাজেই কাউওকে যখন অন্ধভাবে অনুসরন করতে হয় তখন একোটা স্বভাবজাত বিরক্তি চলে আসে।

জাসোলার আশেপাশে বলতে গেলে ,মেট্রো স্টেশন আর শাহীনবাগেই গিয়েছি। এ জায়গাটা খুবই নিরানন্দ আর রসকষ বিহীন। পালাতে মন চাইছে।

এমেক্স দ্যা সেইভিয়র

এমেক্সের দূর্নাম বাংলাদেশ জোড়া। দেশে যখনই এমেক্সের কার্ড বের করতাম, বেশিরভাগ দোকানদারের ২ পার্সেন্ট চেহারা বিগড়ে যেত। ভারতে এসে আবার এক অদ্ভুত ঝামেলায় পড়লাম। এদের কোন অনলাইন শপই বাংলাদেশী কার্ড নিতে চাচ্ছে না। 

আমি এয়ারটেলের সিম কিনেছি। নিজের প্রয়োজনে আরো কিছু বেশি ডাটা দরকার হওয়াতে অনলাইনে রিচার্জ করতে গেলাম। কিন্তু কেউই বিদেশী কার্ড নিবে না। ভিসা-মাস্টার-এমেক্স সব ফেইল্ড।

এরপর মোবাইলে পে-টিএম নামিয়ে মোবাইল রিচার্জ করতে পারলাম, সেই নাখাসতা এমেক্স দিয়েই। অদ্ভুত, ভিসার বদলে এরা এমেক্স এক্সেপ্ট করছে। 

দিল্লী নামা-১ 3

ভারতে আসলে আমি সবথেকে বিড়ম্বনায় পড়ি কার্ড দিয়ে পেমেন্ট করতে গিয়ে। শেষবার চেন্নাই গিয়েছিলাম যখন, সেখানে আমার দুটো কার্ডের ডিটেইলস চুরি হয়। কিভাবে জানি না! শেষ পর্যন্ত সে দুটো আমাকে বন্ধ করে দিতে হয় আর টাকা উদ্ধারে লেগে যায় প্রায় একমাস।

ভারতে ইন্টারন্যাশনাল কার্ড নিতে ছোট দোকানগুলোর খুব গড়িমসি। এরা চার্জ বেশি দিতে হবে দেখে এই ফিচার বাদ দিয়ে পজ মেশিন নেয়। তবে কোন দোকানই আমাদের দেশের মত আলাদা করে ২% দাবি করে নাই।

আপনার খারাপ লাগবে কনভার্শান রেট দেখে, ৩% মার্কআপ ফি দিতে গিয়ে মন খারাপ হয়ে যায়। 

ভিসা কার্ড দিতে এটিএম থেকে টাকা তুলতে গেলাম। কারেন্ট বা চেকিং একাউন্ট দিয়ে হচ্ছে না দেখে সেইভিংস একাউন্ট সিলেক্ট করে দিলাম, এবার হয়েছে। কিন্তু প্রায় ২ হাজার টাকা বেশি কেটেছে প্রতি ১০০০০ রুপি তুলতে গিয়ে। এটা আরেক সমস্যা। Without Conversion দিয়ে টাকা তুলতে গেলে টাকা পাচ্ছি না। আর With Conversion দিলে দেখা যায় লসের পাল্লা ভারি।

সারা পৃথিবীতে যদি একটাই মুদ্রা থাকত তবে বেশ ভাল হোত। আমি নিজে অনলাইন প্রফেশনাল হবার কারনে এই ব্যাপারগুলো আমাকে সবসময়ই ভাবায়।

তবে এবার মোটামুটি সব বড় বড় শপিং মলেই ভিসা এবং এমেক্স দিয়ে পেমেন্ট করতে পেরেছি। এমেক্সের যে দূর্নাম সেটা কিছু হলেও কমেছে মনে হচ্ছে। এদের ICICI আর Pine Lab এর পজ মেশিন এমেক্স NFC পেমেন্ট ঝামেলা বিহীনভাবেই গ্রহন করেছে।

Cash is always the king – বাইরে ঘুরতে গেলে এই কথাটা খুব বেশি করে মনে হবে। ক্যাশলেস সোসাইটি গড়তে গেলে সবার আগে একটা অভিন্ন মুদ্রা ব্যবস্থা আনতে হবে অথবা ফরেক্স ফি এত কমিয়ে আনতে হবে যেটা বোঝাই যাবে না।

0 Comments

মন্তব্য

দেলোয়ার জাহান

মনের একান্তে কিছু কথা থাকে যা কাউকে বলা যায় না। বলতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খায় আমাকে। সে সকল হাবিজাবি জীবন দর্শন আর কিছু অসময়ের কাব্য নিয়ে আমার লেখালেখির ভুবন।

Pin It on Pinterest

Share This