ব্যস্ততা

Jun 26, 2022গল্প0 comments

আমি ফোনের ওপাশ থেকে অর্পার ফোঁপানির আওয়াজ পেলাম বলে মনে হল। কিছুক্ষন চুপ করে থেকেও যখন অর্পা কথা বলছিল না তখন আমি জানতে চাইলাম, আমি কি ফোন রেখে দেব?

জানতাম আমার এই কথায় অর্পা আরো রেগে যাবে। মাঝে মাঝে কাছের কিছু মানুষকে অকারনেই রাগিয়ে দিতে ভালো লাগে। অর্পা আমার সেরকমই একজন। তাকে রাগিয়ে দিয়ে অসম্ভব রকমের একটা পৈশাচিক আনন্দ হয় আমার। কেন হয় জানি না… কিন্তু এই আনন্দটা বড় তীব্র, অভিমানের মত।

– জীবনের ব্যস্ততায় একদিন সবাই মরে যায়। তুমি ঠিক ততক্ষনই জীবিত আছ যতক্ষন তোমার কোন প্রিয়জন তোমাকে মনে রাখছে। আজ যে কাজের বাহানায় তুমি আমাকে ছেড়ে দূরে চলে যেতে চাচ্ছ, সেটা কি তোমার বৃদ্ধ বয়সে সুখের স্মৃতি হবে?

আমি কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেলাম, অর্পাকে এত গুছিয়ে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে বোধহয় এই প্রথম শুনছি। এই শ্যামলা মতন ছিপছিপে গড়ন মেয়েটার যে একটা গভীর জীবনবোধ থাকতে পারে আমি হাসি-ঠাট্টা আর অবহেলার আড়ালে সেটা ভুলেই যেতে বসেছি।

– অর্পা আমি সেটা মিন করিনি…। কিন্তু ভালোভাবে বেঁচে থাকতে হলে আমাকে টাকা উপার্জন করতে হবে। তোমার মত ব্যবসায়ী পিতার কন্যা আমি নই। তোমার পিতা কন্যা দায়গ্রস্থ না হতে পারেন, কিন্তু আমার পিতা পুত্র দায়গ্রস্থ…।

– এরকম কিছু আছে বলে শুনিনি… পুত্র দায়গ্রস্থ…পিতা। অর্পা হাসে। আমি মোবাইলের মাঝেও তার টোলপড়া গাল দেখার কল্পনা করি।

– আলবৎ আছে… তুমি পড়ার বইয়ের বাইরে কিছু পড়না বলেই জানোনা। যদিও আমি জানি কথাটা সত্যি না। আমার দেখা সেরা পড়ুয়াদের একজন সে। কিন্তু একাডেমিক পড়ার বাইরে উপন্যাস, কবিতা এরকম কিছুই অর্পা পড়ে না। তার পড়া যত বড় বড় মেডিক্যাল জার্নাল, পলিটিকস, আর এনভায়রনমেন্ট নিয়ে। তাই হঠাত করে যখন জীবনের রুঢ় সত্য কথা তার মুখ দিয়ে বের হয়ে আসে আমি দুইয়ে দুইয়ে চার মেলানোর চেষ্টা করি।

অর্পার মন খারাপ, আমি দূরে চলে যাচ্ছি বলেই খারাপ, নাকি ভেবে নিয়েছে আমি আর ফিরে আসব না?

– ঠিক আছে বিয়েতে তোমাকে এত বিশাল যৌতুক দেব যে তোমার পুষিয়ে যাবে। তবু না গেলে হয় না! দেশেই একটা কিছু করো।

– নিজের একটা আত্মসম্মানবোধ ও তো আছে নাকি! শশুরেরটা খাবো আর এমন সুযোগ হেলায় হারাবো এমন রোমান্টিক আর লোভি আমি নই।

– কোনদিন হতেও পারবে না। যাচ্ছতো সেই ভালো বেতনের লোভেই…।

– তবুও নিজের উপার্জন হবে অর্পা… পুরুষ হবার বেশ কিছু যন্ত্রনা আছে, ইগো সমস্যা তার মধ্যে একটা। তুমি একটা মেয়ে হয়ে সেটা বুঝবে না।

– আমি একজন ডাক্তার… তোমাদের অলিগলি আমার চেনা।

– হতে পারে… কিন্তু মনের অলিগলে চিনতে এখনো তোমাকে অনেক দূর পাড়ি দিতে হবে। তুমি সার্জন না হয়ে সাইকিয়াট্রিষ্ট হলে ভালো করতে।

– তোমার মত পাগলের চিকিৎসা করার কোন দরকার নেই আমার…।

– না সেটা করতে বলছি না… অন্তত বুড়ো বয়সে যখন আমার ভিমরতি ধরবে তুমি সেটা সহ্য করতে পারবে। আমরা দুই বুড়োবুড়ি টেমসের পাড়ে দাঁড়িয়ে জীবনের শেষ সূর্যাস্ত দেখব …।

অর্পা কিছু বলছে না… মনে হয় আবার নীরব কান্নার বৃষ্টি হচ্ছে। সকাল সকাল এই রোমান্টিক সিনে অভিনয় করতে আমার একদম ভালো লাগছে না। মেয়ে মানুষ এত অক্টোপাসের মত ভালোবাসে কেন? মাঝে মাঝে দমবন্ধ হয়ে আসে…।

– ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয় রাতুল…। আমরা টেমসের পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকব না বুড়িগঙ্গার পাড়ে সেটা চার বছর পরেই দেখা যাবে।

আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হুট করে লাইন কেটে দিল অর্পা। আমি ফোনের দিকে তাঁকিয়ে বসে রইলাম। যদিও অর্পার শেষ কথার কিছুই বুঝতে পারলাম না, কারন মাথায় এখন রাজ্যের চিন্তা। সারাদিনের ব্যস্ততা আমার মাথায় কনসার্ট শুরু করে দিয়েছে।

0 Comments

মন্তব্য

দেলোয়ার জাহান

মনের একান্তে কিছু কথা থাকে যা কাউকে বলা যায় না। বলতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খায় আমাকে। সে সকল হাবিজাবি জীবন দর্শন আর কিছু অসময়ের কাব্য নিয়ে আমার লেখালেখির ভুবন।

Pin It on Pinterest

Share This