আলিনা অধ্যায় – ৭

Apr 28, 2020আত্মকথন0 comments

||এক||

হাত থেকে বোতলটা পড়ে গেল। মেয়েটা হাসছে আমার দিকে তাঁকিয়ে, বলল –
ঃ দেখেছ এখন তুমিও বোতল ফেলেছ, খালি আমাকে বলো…।
ঃ Sorry; Baba is getting sloppy.
: না বাবা… You are getting clumsy.

আমি আক্ষরিক অর্থেই চমৎকৃত হলাম কন্যার শব্দ চয়নে। ক্লামজির মত শব্দ তার এই বয়সে আমার আয়ত্তের বাইরে ছিল। তার উপর কখন ব্যবহার করতে হবে সেটা বুঝতে পারাটাও স্মার্টনেসের লক্ষন।

যুগ পাল্টাচ্ছে, স্মার্ট ডিভাইসের সাথে সাথে মানুষজনও স্মার্ট হয়ে যাচ্ছে। যারাই বদলাতে চাইবে না, সময়ের পেছনে তাদের ছুঁড়ে ফেলে দেবে নিয়তি।

।। দুই ।।

কেমন যাচ্ছে কোয়ারিন্টিনের দিনকাল? অবশ্যই ভালো না। তবে শিশুরা কিভাবে যেন সব পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেয়। এদের অভিযোজন ক্ষমতা আমাদের থেকে অনেক অনেক গুনে বেশি। বাহিরের এত তোলপাড় তাকে ভাবায় না।

কিন্তু বন্দী জীবন কেমন লাগে? চিড়িয়াখানায়তো খুব শখ করে আমরা খাঁচার ভেতরের পশু-পাখি দেখতে যাই। এবার তার স্বাদ কিছুটা হলেও পাচ্ছি।

আলিনাকে অবশ্য খুব বেশি ভাবতে হচ্ছে না। স্কুল বন্ধ, মা বাসায়, বাবা বাসায় – এর থেকে আনন্দের আর কিছু হতে পারে না। তবে মাঝে মাঝে এসে এটা ওটা আমাকে দেখিয়ে কিনে দিতে বলে এভাবে –

ঃ বাবা, ক’রেনা (Corona) ভাইরাস চলে গেলে আমাকে বাইরে নিয়ে গিয়ে কিনে দিও?

আমি মাথা নাড়ি। আপাতত মাথা নাড়া বাদে কিছু করার নাই। চার দেয়ালের মাঝে আমাদের জীবনটা হয়ে গেছে পানসে।

সারাদিন স্মার্ট ডিভাইস নয়তো টিভি। বাবা ব্যাস্ত তার কম্পিউটার নিয়ে – মা ব্যাস্ত কাজে। আলিনা শুধু খুঁজে বেড়ায় কি করা যাবে। এর মাঝে কিছুটা বাঁচোয়া ছাদ থাকাতে। চাচ্চুর সাথে নতুন শখে ঘুড়ি উড়ানোর বিকেল আর বৃষ্টির পানিতে নৌকা ছেড়ে দেয়া।

আলিনা অধ্যায় - ৭ 1

যদিও ওড়ানোর থেকে অন্যদের ঘুড়ি নিয়ে কাটাকাটি খেলা দেখতেই তার বেশি ভালো লাগে। উৎসাহী জনতা যাকে বলে আরকি।

বাবাকে তো জিজ্ঞেস করেই ফেলল বাবা ঘুড়ি ওড়াতে পারি নাকি। আমি হ্যাঁ বলার পরেও তার সন্দেহ যায় না। শেষ পর্যন্ত তার সাথে ছাদে গিয়ে ঘুড়ি উড়িয়ে প্রমান দিতে হল বাবা ঘুড়ি ওড়াতে পারে।

তার ঘুড়ি সে অবশ্য ওড়াতে দিতে চায় না। তার ধারনা সুতা ছিড়ে ঘুড়ি উড়ে যাবে। তার সকল আগ্রহ অন্যদের ঘুড়ি কখন আমাদের ছাদে পড়বে আর সে সেটা দখল করতে পারবে।

ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে একটা জিনিস খেয়াল করলাম, এখন ঘুড়ির সুতা সব প্লাস্টিকের। আমাদের সময় এমন ছিল না। আমরা তুলার সুতা ব্যবহার করতাম। তখন লায়ন নামে একটা সুতার ব্রান্ড ছিল সবচেয়ে প্রিয় আমাদের। মাঞ্জা দেয়ার জন্য কাঁচের গুড়া, শিরিষ, দেয়ালে রঙ করার আঠা, ভাতের মাড় আরো নানা কিছু ব্যবহার করতাম।

প্রতিযোগিতা ছিল কার সুতার ধার সব থেকে বেশি হয়। এই ঘুড়ি ওড়ানো আর ভো-কাট্টা ঘুড়ি ধরার প্রতিযোগিতায় কত মারামারি যে করেছি ইয়াত্তা নাই।

হায় শৈশব, আমাদের সেই দুরন্ত ছুটে বেড়ানোর মাঠগুলো ভরে গেছে অট্টালিকায় আর এসি শপিংমলে। আমাদের সন্তানেরা এখন বাবু ল্যান্ড আর টগি ওয়ার্ল্ডে যায়। কোথায় পাখির বাসা আছে, জাম গাছে কিভাবে উঠতে হয় সেটা তাদের দেখা হয়নি।

আমরা যেভাবে হারিয়েছিলাম উত্তর পুরুষের গ্রাম্য স্বাধীনতা, তারাও হারাচ্ছে আমাদের মত মুক্ত শৈশব।

কিন্তু মানিয়ে যায়, কিভাবে যেন সবাই সব কিছুতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। যে জিনিস জন্ম থেকে দেখা হয়নি সেটার জন আফসোস করেন শুধু অভিভাবকেরা। বাচ্চারা এই ইট-কাঠের দেয়ালেই খুশি।

।। তিন ।।

শিশুরা যা দেখে তাই শেখে। আমরা যতই তাদের বিভিন্ন ভাষা এবং আচরন শেখানোর চেষ্টা করি না কেন, তারা অবচেতনে আপনাকেই অনুসরন করবে। আপনি যদি বাসায় মারামারি আর গালিগালাজ করেন তবে আপনার সন্তানের উপর সেটার প্রভাব পড়তে বাধ্য।

আমি কম্পিউটার টেবিলের উপর পা তুলে দিয়ে বসে বসে মুভি দেখি মাঝে মাঝে। আলিনা সেটা খুব লক্ষ্য করে। বাবাকে নকল করতে তো দোষ নেই। তাইতো বৃষ্টির সময় বারান্দায় চেয়ার টেনে গ্রিলে পা তুলে দিয়ে চা-খাওয়া চাই।

আলিনা অধ্যায় - ৭ 2

শিশুরা মানিয়ে নেয়, খুব বেশি মানিয়ে নেয়। একবারের জন্যও বলে না বাবা আমাকে বাইরে নিয়ে চল। সে জানে বাইরে ক”রেনা (Corona) ভাইরাস আছে।

যাক, এপ্রিল শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের মৃত্যু সংখ্যা কম। অথবা আমরা গুনতে ভুল করি। আনফিশিয়াল লকডাউন আস্তে আস্তে শিথিল করা হচ্ছে। রমজান শুরু হয়ে গেছে। অর্থনীতির চাকা স্থবির।

আল্লাহ না করুক যদি পরিস্থিতি আমাদের হাত-ছাড়া হয়ে যায় এই শিথিলতায় তবে এর দায়িত্ব কে নেবে? এই গার্মেন্টস মালিকেরা নাকি সরকার?

আমরা অনেকটা পড়েছি উভয় সংকটে। একূল রাখি না ওকূল রাখি সেই সংকটে।

0 Comments

মন্তব্য

দেলোয়ার জাহান

মনের একান্তে কিছু কথা থাকে যা কাউকে বলা যায় না। বলতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খায় আমাকে। সে সকল হাবিজাবি জীবন দর্শন আর কিছু অসময়ের কাব্য নিয়ে আমার লেখালেখির ভুবন।

Pin It on Pinterest

Share This