ম্যাজিক রাশেদ

Aug 21, 2018গল্প, সাহিত্য0 comments

রাশেদ বিশাল ড্রইং রুমের এ মাথা থেকে ও মাথা আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিল। তীক্ষ্ণ ব্যবসায়ীর দৃষ্টি তার। আনুমানিক চল্লিশ লাখ টাকার মালামাল আছে এইখানে। সৌখিন বলা যাবে না, তবে দামি জিনিস কেনার প্রতি একটা ঝোকঁ আছে মালিকের বোঝা যায়। বাসাটা কেমন যেন হোটেল হোটেল বানিয়ে ফেলেছেন ভদ্রলোক।

রাশেদ আবার ভাবতে বসল – লস খাওয়া বিজনেস করে এত আভিজাত্য কিভাবে দেখান মামুন সাহেব? হিসাব মেলানো যখন যায় না তখন ধরে নিতে হয় কোথাও একটা গোঁজামিল তো আছেই।

রাশেদ এর অপেক্ষার সময় প্রায় আধা ঘন্টার উপর হয়ে গেছে। আরেক কাপ কফি হলে মন্দ হোত না। কফিটা বেশ দামী ব্লেন্ডের ছিল। কোথায় যেন পড়েছিল সবথেকে দামি কফি বীজ গুলা প্রসেস হয় বেড়াল আর হাতির পেটের এনজাইম দিয়ে। আইভরিতে হাতিকে বাধ্যতামূলক ভাবে কফি ফল খাওয়ানো হয় এরপর হাতি হজম করে বীজ মলের সাথে বের করে দেয়।

সেই বীজ হাতির মল থেকে আলাদা করে তৈরি হয় বিখ্যাত ব্লাক আইভরি কফি। স্বাদ অনেকটা চকোলেটের মত হয়ে যায় তখন। দেশের বাইরে একটা লম্বা সময় থাকার কারনে অনেক ধরনের কফিই খেয়েছে রাশেদ কিন্তু আইভরি কখনো টেষ্ট করে দেখা হয়নি।

মামুন সাহেব কি আইভরি কফি খায়? একবার জিজ্ঞেস করে দেখবে নাকি?

ধুত… কি সব আজে বাজে ইনফরমেশন মাথায় আসছে এখন? রাশেদ এসেছে রেশমা-বুর ব্যাপারে কথা বলতে। মামুন সাহবের কাছ থেকে টাকার হিসাব নিতে। এই কাজও তাকে করতে হবে কখনো ভাবেনি রাশেদ।

ম্যাজিক রাশেদ 1

—-***—

রেশমা-বু রাশেদের দূর সম্পর্কের চাচী হয়। ছোট বেলায় তার কাছেই অনেকটা সময় থেকেছে রাশেদ। বাবার বদলির চাকরি, আরো দুই সন্তানের দেখা শোনা করতে গিয়ে মা যখন হিমসিম খাচ্ছিল রেশমা-বু-ই তখন অনেকটা ত্রান কর্তা ছিল তাদের। তার মা বুবু ডাকত রেশমাকে, রাশেদও তখন থেকে রেশমা-বু বলেই ডাকে। তাদের তিন ভাই বোনের কাছে তিনি আজীবন রেশমা-বু। মায়ের পরেই মামুন যাকে এই পৃথিবীতে সবথেকে বেশি সম্মান করে।

রাশেদের ব্যক্তিগত অনেক ঋন আছে বুর কাছে। তার অগনিত দুপুর আর সন্ধ্যে কেটেছে বুর কোলে গল্প শুনে। তার কৈশোর কেটেছে মায়ের শাসন আর বুবুর আস্কারায়। সেই নারকেল তেলের গন্ধ মাখা চুল আর একটা মায়াবী চোখের চাহনী এখনো রাশেদ মাঝে মাঝে মনে করতে পারে।

নদীতে কত জল গড়াল, রাশেদও একসময় দেশ ছাড়ল জীবিকার তাগিদে। তারপর কত চড়াই-উতরাই গেল। রেশমা-বুর খোঁজ খবর তারপর অনেক দিন নেয়া হয়নি।

এবার দেশে এসে শোনে বুবুর জামাই মারা গিয়েছে প্রায় মাস তিনেক হয়েছে। যার সাথে বিজনেস করত শেষ দিকে কি যেন একটা টাকা পয়সার ঝামেলায় বুবুর জামাই রাগ করে আর তার সাথে কথা বলত না। ব্যবসা নাকি অনেক লস হতে শুরু করেছিল। তাও প্রায় বছর তিনেক আগের কথা।

রাশেদ যতদুর মনে করতে পারে, বুবুরা বেশ স্বচ্ছল ছিলেন। তাদের নিজেদের কাজ করবার জন্যই ২ জন কাজের লোক ছিল। সেই হিসেবে রাশেদরা অনেক গরিব ছিল বলা যায়। বাবার পাঠানো টাকায় অনেক সময়ই চলত না। মার কাছে অনেক পরে শুনেছে বুবুই নাকি তখন সব সাহায্য করতেন, আর কাউকে বলতে মানাও করতেন।

হয়ত নিজের সন্তান ছিল না বলেই রাশেদকে দু-হাত ভরে ভালোবেসেছেন। মাতৃত্বের স্বাদ নিতে চেয়েছেন কৃপণের মত। কত কাল আগের কথা, কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই রাশেদ এখনো সেই নারকেল তেলের গন্ধ আর মায়বী চোখ দেখতে পায়। দেশে এসে তাকে এতোটা করুন দশায় দেখতে হবে বলে রাশেদ ভাবেনি।

চরম অর্থকষ্টেও বুবু রাশেদের মাকেও কিছু বলেনি। ঢাকায় নেমে রাশেদ একদিন পরেই বুবুর খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারে এই করুন দশার কথা। নিজের ভেতর একটা তীব্র অভিমান নিয়ে ছুটে আসে ঢাকা থেকে এখানে। বুবুর প্রতি রাগ, মার প্রতি রাগ, তার শৈশব-কৈশরের গ্রামের প্রতি রাগ সব কিছু উথলে ওঠে তার আসার সময়।

বুবু কেন একবারও কাউকে কিছু বলল না? মা ও তো খবর নিতে পারত। তাকে কেন কেউ কিছু জানাল না? রাশেদ এখন অনেক বড় হয়েছে, অনেক বড়, বুবু দেখলে খুশি হতেন। অর্থে, বিদ্যায়, সম্মানে, ক্ষমতায় সব কিছুতেই রাশেদ তার আশেপাশের অনেককেই ছাড়িয়ে গেছে।

—-***—

ম্যাজিক রাশেদ 2

কিন্তু রাশেদকে হতাশ করে দিয়ে বুবু শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন। রাশেদকে চিনতেই পারলেন না। রাশেদ একজন ভেঙ্গে পড়া মানুষকে দেখল তার সামনে। এই বুবু সেই মানুষটা আর নেই। কল্পনায় রাশেদ কৈশরে যাকে ছেড়ে গিয়েছিল শহরে বাবার হাত ধরে, তার সাথে মেলানোর চেষ্টা করে মিল খুঁজে পেল না।

রাশেদের বুক ভেঙ্গে কান্না আসে। কি বিশাল উঠান ছিল বুবুর। বাড়ির পেছন দিকে একটা বড় জারুল গাছ ছিল। দুপুরটা কাটত সেখানেই। মাঝে মাঝে বুবু এসে একটা দুটো মুড়ির মোয়া দিয়ে যেতেন, অনেক সময় বা আচারের বয়ামটা চুরি করে নিয়ে রাশেদ নিজেই সেখানে বসে পড়ত। সাথে থাকত স্কুল পালানো আরো কয়েকজন দুরন্ত কিশোর। বুবু দেখেও দেখতেন না। রাশেদ এর জন্য তিনি চোখকানা, দলকানা।

মাস্টার মশায়রা বিচার নিয়ে আসতেন প্রায়ই মার কাছে।

রাশেদ জানত কোথায় পালাতে হবে। তার স্নেহের আশ্রয়স্থল কোথায়। একবার বুবুর সীমানায় পাড়া দিতে পারলে দুনিয়ার কোন শক্তিই তার অনিষ্ট করতে পারবে না।

বুবুর বাড়ির উপর কদবেল আর মিষ্টি পেয়ারার গাছ ছিল কয়েকটা। পাড়ার কেউ ধরার সাহস না পেলেও রাশেদ আর তার গ্যাং এর জন্য দুয়ার সবসময় অবারিত। কত শত দুপুর, বিকেল আর সন্ধ্যা রাশেদের চোখের কোনে ছলছল করে ওঠে।

সেই বাড়ির কি জীর্ন দশা। জারুল গাছটাও নেই, নেই পেয়ারা আর লেবু ফুলের তীব্র সুবাস। রান্নাঘরটাও ধ্বসে পড়ার দশা। কতদিন উঠান ঝাড়ু দেয়া হয়নি কে বলবে। বুবুর ঘরটাও কি নোংরা হয়ে আছে। খাবার দাবার কোথা থেকে আসে কে জানে? বেঁচে আছেন কি করে এই মহিলা?

—-***—

রাশেদের সাথে তার এক সহকারী এসেছিল সেই প্রাগ থেকে। রাশেদকে ছায়ার মত ফলো করাই তার কাজ। হাজার হোক মালিকের একমাত্র হবু জামাতা। রাশেদের হবু শশুর পুরো ইউরোপ জুড়ে বিশাল এক হোটেল চেইনের মালিক।

মালিকের এখানে জয়েন করার পর থেকেই দেখেছে ”রাশেদ” বাদে কিছুই বোঝেন না ভদ্রলোক।

পরে শুনেছে, তার একমাত্র মেয়েকে জীবন বাজি রেখে রেপিস্টের হাত থেকে বাঁচানো এই সাহসী বাংগালী যুবকের কথা। বিজনেস বুদ্ধিতে রাশেদ এর ক্ষুরধার মেধার পরিচয় পাবার পর থেকে তাকে আর ছাড়তে চাননি ভদ্রলোক। রাশেদ দেশে যেতে চায় শুনে সাথে তার অ্যাসিস্টেন্টকেও বাধ্যতামূলক করে দিয়ে দিয়েছেন।

রাশেদের সহকারী বিশালদেহী এক জার্মান। বসকে গত দুই বছরে চাকুরি শুরু করার পর কখনো কাঁদতে দেখেনি। বেশ কয়েকবার প্রায় মৃত্যুর কাছ থেকে বেঁচে এসেছে তারা দুজন। দেখেছে সুঠামদেহী এই বাঙ্গালী যুবকের কত বড় কলিজা। একবারতো বার ফাইটে বস একাই চারটাকে সাবাড় করে দিয়েছিল। সেবার কাহিনী থানা পুলিশ পর্যন্ত গড়ালেও শশুরের হস্তক্ষেপে জরিমানা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল।

সেই লোকের চোখে পানি? সাম্থিং ইজ ভেরি রং হিয়ার। আত্বীয়কে দেখলে কেউ কাঁদে?

ঃ বস কোন সমস্যা?

ঃ নাহ। এভ্রিথিং ইজ ফাইন। সামওয়ান জাস্ট স্টোল মাই চাইল্ডহুড ম্যাজিক ফ্রম মি।

জার্মানের নাম আলফন্সো। মুহুর্তেই বুঝে গেল বস কি বোঝাতে চেয়েছেন। একসাথে তারা অনেক ব্যবসায়িক শত্র‌ু মোকাবেলা করেছে গত দুই বছরে। লুটেরা, খুনেরা, বেশ্যার দালাল কত কিছু সামলেছেন বস শক্ত হাতে। তার শৈশব কৈশোরের কত গল্প করেছেন অবসরে। তার কাছে তার শৈশবের স্মৃতিরা হল ম্যাজিক। যখনই কোন সমস্যায় পড়ে চোখ বুঝতেন, আলফন্সো জানতে চাইতে কি ভাবছেন বস?

রাশেদ বলতোঃ ম্যাজিক রাশেদকে টেনে আনছি শৈশব থেকে।

সেই ম্যাজিক যদি চুরি হয়ে যায় … তার মানে কেউ একজন বসকে বড় ধরনের একটা ব্লো দিয়েছে। তার ম্যাজিক চুরি হয়ে গেছে।

ঃ বস, আমাকে দুই দিন সময় দেন আমি সব ঠিক করে দিচ্ছি।

রাশেদ ক্লিষ্ট হাসে। অ্যাল’ এটা বাংলাদেশ, আমাদের ইউরোপ না। এখানে তোমার ক্ষমতা কোন কাজে আসবে না। তুমি বরং আমার চাচীকে ঢাকা নেয়ার ব্যবস্থা কর। ওনাকে এই অবস্থায় আমি ফেলে যেতে পারব না। খাওয়া-দাওয়াও মনে হয় ঠিক মত করেন না অনেকদিন। চিকিৎসা দরকার। দরকার হলে তাকে সাথে করে আমি প্রাগে যেতে চাই। সেই ব্যবস্থা কর পারলে।

ঃ সর্বোচ্চ চেষ্টা করব বস, এম্বেসিতে আমাদের কন্টাক্ট আছে। কিন্তু, এই মহিলা আসলে কে?

ঃ শি ইজ দ্যা মাদার অফ ম্যাজিক রাশেদ, অ্যাল। আমার দুইটা মা। একজন জন্মদাত্রী, আরেকজন ম্যাজিক রাশেদকে আগলে রেখেছেন যতদিন পেরেছেন। আমি খুব লজ্জিত আরো আগে তার খবর নিতে পারিনি, কিছু প্রায়শ্চিত্ব করতে চাই।

ঃ বুঝেছি বস, শি ইজ ইয়উর “বু” আই রিমেমবার নাউ। আপনি কোন ছবি দেখাননি তার। বাট, আই নো হু শি ইজ। আপনি আমাকে দুই দিন সময় দেন আমি খবর নেই ওনার এই অবস্থা কেন?

ঃ কি করতে চাও?

ঃ বস, আপনিইতো বলেছিলেন মানুষ দুইটা জিনিসকে ভয় পায়, মানি এন্ড পাওয়ার। একটা আরেকটার পরিপূরক। এখানে আমদের ক্ষমতা নাই, কিন্তু মানি ক্যান বি এরেঞ্জড। আর টাকার হাত-পা, বন্ধু বান্ধব সব আছে।

 

কথোপোকথনের এই পর্যায়ে এক বয়স্ক মহিলা এসে ঢুকলেন উঠানে।

ঃ আপনারা কারা, এইখানে কি করেন?

ঃ আমি রাশেদ, ঢাকা থেকে এসেছি। উনি আমার বুবু হন। ওনার এই অবস্থা কেন?

ঃ কি অবস্থা?

ঃ এই রকম হতদরিদ্র অবস্থায় তো তাকে দেখিনি।

ঃ শেষবারত কবে দেখছিলেন আপনার রেশমা বু-রে? গত দুই মাস ধরে আমিই তার দেখাশোনা করি। জামাই মরনের পর হে আর শোক কাটাই ওঠতে পারে নাই। জামাইর চিকিৎসা করতে গিয়া জমি ব্যবসা সব গেছে। কোন রকমে এখন চলে, আমি আইসা দুই বেলা রাইন্ধা দিয়া যাই। হের পোলা মাইয়াও কেউ নাই। কাউরে ঠিকমত চিনতেও পারে না। …আপনারেওতো আগে দেখি নাই।

ঃ আমি বাইরে থাকি। বুর জামাইর কি হয়েছিল? ব্যবসাতো ভালোই ছিল তার।

ঃ হেইডা আমি কইতে পারুম না, মামুন সর্দার ভালো জানবো। সর্দার ভাই-ইতো তার লগে ব্যবসা করত, তারপর ব্যবসায় লস খাইল। .

একটু বিরতি দিয়ে আবার বলা শুরু করল মহিলা…

“রেশমার জামাই মদখোর হয়া গেছিল। রেশমা অনেক চেষ্টা কইরাও ফিরাইতে পারে নাই। এমুন সোনার সংসার ছারখার হয়া গেল। কোন পোলাপাইন নাই। শুনছি জায়গা-জমিও মামুন সর্দার এর কাছেই বেইচা দিসে।”

রাশেদ বুঝল কোথাও একটা ঘাপলা আছে। মামুন সর্দারের সাথে কথা না বললে বোঝা যাবে না।

—-***—

ম্যাজিক রাশেদ 3

বুবুর জামাই যার সাথে ব্যবসা করত তিনি হলেন এই মামুন সাহেব, যার ড্রইং রুমে রাশেদ গত আধা ঘন্টা ধরে বসে আছে।

মামুন সাহেবের হোলটা কি? একটা পুরুষ মানুষ গোসল করতে এত সময় নেয় নাকি? কফি দিয়ে যাবার সময় কাজের ছেলেটা বলে গেল মাহাজনের আসতে ৩০ মিনিট এর মত লাগবে। কিন্তু ৩০ মিনিট পার হয়ে গেছে অনেক আগে।

অবশেষে সৌম্য দর্শন এক ভদ্রলোক ঢুকলেন ড্রইং রুমে। বয়স পঞ্চান্ন থেকে ষাটের মাঝামাঝি হতে পারে। গায়ে সাদা ফতুয়া আর পাজামা পরনে। চাপ দাড়ির রং কালো। ভদ্রলোক নিয়মিত রং দেন চুল আর দাড়িতে বোঝা যায়।

রাশেদ সম্মান দেখানোর জন্য উঠে দাড়াঁল না। সালামও দিলও না। এ কয়দিনে এই লোকের ব্যপারে যে সব ইনফরমেশন কালেক্ট করেছে তাতে একে সম্মান দেয়াটাই বৃথা।

ঃ চাচা আপনার কফিটা ভালো।

ঃ জ্বী বাবা? ভদ্রলোককে একটু থতমত খেতে দেখল রাশেদ। কফির প্রশংসা নিশ্চই আশা করেননি। তাকে দেখে মনে হচ্ছে না  তিনি গোসল করতে গিয়েছিলেন। কেমন যেন নার্ভাস আর বারবার দরজার দিকে তাঁকাচ্ছেন, যেন কারো আসার অপেক্ষা করছেন।

ঃ বসেন চাচা, আমি আপনার সাথে একটু কথা বলতে আসছি। দশ মিনিটের বেশি সময় নিবও না। আপনি অবশ্য আমাকে বসিয়ে রেখেছেন প্রায় পয়ঁতাল্লিশ মিনিট হোল।

ঃ গোসলে ছিলাম বাবা। নামাজের ওয়াক্ত হয়েছে তো। তা তুমি যেন কে বাবা? আমার কাছে কোন দরকারে এসেছ?

ঃ আমি কে সেটা আপনি ভালো করেই জানেন চাচা। আমি মিজি বাড়ির ছেলে, রাশেদ। একযুগের বেশি সময় হয় গ্রাম ছেড়েছি কিন্তু গ্রামের কথা ভুলে যাইনি। আমি কেন এসেছি সেটাও বোধহয় আঁচ করতে পারছেন? আপনার মত চতুর লোকেরতো এতক্ষনে ফোন করে নিজের লোকজন ডাকার সময় হয়ে যাবার কথা।

ঃ এইগুলা কি বলতেস বাবা? তুমি আমার মেহমান। তোমার খাতির যত্নের যেন কোন কমতি না হয় সেটাই বলে আসতেছি। আর তুমিতো আমদের গ্রামেরই পোলা।

ঃ আর তুই একটা খা… … … পোলা। রাশেদ ঠান্ডা মাথায় বলল।

ঃ কি বললা তুমি? হতচকিত মামুন সর্দার।

ঃ কই কিছু বলি নাইতো চাচা। বলছি আপনি একটা ………কির পোলা। আমি গ্রামের পোলা তো তাই সত্যি কথা মুখ দিয়া বের হয়া যায়।

ঃ তুমি… তুমি কারে কি বলতেস… মাথা ঠিক আছে? মামুন সর্দার আবার ঘামাচ্ছে। কোনদিন কল্পনাও করতে পারে নাই এমন পরিস্থিতিতে তাকে পড়তে হবে। রেশমার জামাই নিঃসন্তান ছিল, আলাভোলা লোক তাকে ঠকানো গেছে কিন্তু কই থেকে এই আপদ আইসা জুটল। ফোন দিয়াও কাউরে পাওয়া যাইতেছে না। টাকা পয়সা তো কম বিলি করে নাই মামুন সর্দার। থানা পুলিশ থেকে শুরু করে এলাকার নেতা সবাইকে টাকা খাইয়েছিল সে।

তার নিজের চামচা দুইজনেরও কোন খবর নাই। তখন থেকে ফোন দিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু কেউ ফোন ধরছে না।

ঃ রেশমা বুরে আমি ঢাকায় নিয়া গেছি মাস দুয়েক আগে জানেন বোধহয়। মামুন সর্দার মাথা নাড়ল।

ঃ জানবেনই তো, আপনিই তো তার বাড়ির দখল নিলেন গত সপ্তাহে। মামুন সর্দার জ্বীহবায় কামড় দিল।

ঃ এসব কি বলছ তুমি বাবা? আমিতো রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্ব নিলাম। তার বাড়ি তারই থাক। যখন আসবে বুঝাইয়া দিব। খারাপ কি করলাম?

ঃ হুম… চাচা আপনার চামচা দুইটারে ওই বাড়ি থেকেই কিছুক্ষন আগে ধরসে আমার লোক। কয়েকটা বাড়ি পড়তেই সব বমি করে দিসে। এখন আপনে বলেন আপনার সাথে কি করা যায়।

খবর নিয়েছি রেশমা-বুর জামাইরে আপনিই মদ খাওয়া শিখাইছিলেন; খারাপ পাড়ায় নিয়া যাইতেন আপনিই; তার সন্তান নাই এই দুঃখে সে আপনার অনেক অন্যায় সহ্য করে গেছে। শেষমেশ তারে ব্লাকমেইলিং ও করছিলেন বলে……।

…থানায় খবর নিসিলাম। এলাকার আগের চেয়ারম্যান ও একই কথা বলল।

…ব্যবসাপাতিও নাকি নিজের নামে করে নিছেন দুই-নাম্বারি করে!

মামুন সর্দার ঘামছে। তার বাসায় বসে তার সামনে এইধরনের কথা বলার বুকের পাটা কারো নেই। কিন্তু এই ছেলে ক্রমাগত তার পাপের ফিরিস্তি দিয়ে যাচ্ছে। ভাগ্যিস তার বউ আর মেয়ে বাসায় নাই। কি কেলেংকারী হোত। মামলা করবে করুক? এই ছেলে নাকি বিদেশ থাকে এখন… সেইখানেই একটা হোটেলে কাজ করে। কয়দিন আর থাকবে এখানে? থানা-পুলিশতো তার পকেটে। কিন্তু একে এখন কিভাবে কাটানো যায়?

ঃ তোমার সাথে আমি এই বিষয়ে কথা বলতে চাই না। কিছু বলার থাকলে তুমি থানায় গিয়া মামলা করতে পার। আমি বে-আইনি কোন কাজ করি নাই।

রাশেদ হাসল। নীঃশব্দ হাসি। তার হাসি দেখে মামুন সর্দারের পিলে চমকে গেল।

এই রকম ভাবে হাসে ভয়ংকর খুনী লোকজন। যখন তারা কোন কিছু করবে বলে ঠিক করে নেয় আর তার আগে শিকারকে একটু বাজিয়ে নেয় তখন। তার নিঃর্দেশে একবার হোসেন ডাকাইত এক লোকরে জবাই দেয়। তখন হোসেন ডাকাতের মুখে এই রকম একটা নিঃশব্দ হাসি দেখেছিল। পাপ তার বাপেরেও ছাড়ে না। কিন্ত সেই হোসেনতো এখন জেলে। মামুন সর্দারই তাকে জেলে ঢুকিয়েছে। সেই হাসি আবার ফেরত আসছে সামনে বসা এই সুটেড-বুটেড ছেলেটার কাছ থেকে।

ঃ শোনেন চাচা মিয়া, আপনে এতক্ষন ফোন দিয়া এলাকার মাতবর, পুলিশ, আপনার চামচা কাউরে পান নাই কেন জানেন? আমি বলেছি তাই। দুই মাস আগে আমি চলে যাবার সময় আপনে রেশমা-বুরে একবার দেখতেও যান নাই। কিন্তু লোক দিয়া আমার খবর ঠিকই কালেক্ট করেছেন। আমি দুই মাস ঘোড়ার ঘাস কাটি নাই। আপনার মত … শুয়োরের খোঁয়াড় বানাচ্ছিলাম। কেউ আপনারে সাহায্য করতে আসবে না এই গ্রামে আর।

যেরকম টর্চার আপনি রেশমা-বু আর তার জামাইরে করছেন তার পুরোটা ফেরত দেব। ভয় পাবেন না। আপনার মত খুন খারাবির মানুষ আমি না। তবে চাইলেই আপনাকে গুম করে দিতে পারতাম। কিন্তু তাতে শাস্তি কম হয়ে যেত।

মামুন সর্দার এর ঘাম ছুটছে, মাথাটা বনবন করে ঘুরছে। সাধারনত থ্রেট দিয়ে অভ্যস্ত সে, কখনও থ্রেট হজম করে নয়। কেউ তার দিকে এইরকম ভাবে আক্রমন করেনি কখনো। কি বলবেন কিছুই ভেবে পাচ্ছেন না।

ঃ  চাচা, জায়গা জমির আসল কাগজ আমি কালেক্ট করেছি, ব্যবসার হিসাব পাতিও একজন উকিল দেখে যাবে আপনার কাছ থেকে। যা কিছু পাওনা রেশমা-বু সব একটা এতিম খানার নামে চলে যাবে। আপনি চাইলে স্বেচ্ছায় দিতে পারেন অথবা আদালতের মাধ্যমেও হতে পারে…… আপনার ইচ্ছা।

আমার দশ মিনিট শেষ প্রায়। আমি উঠি আজকে। যাওয়ার আগে একটা সাবধানবাণী… … … আপনার খোঁজ খবর নেয়ার জন্য আপনারই পরিচিত একটা লোক ভাড়া করেছি। আজকেই নিয়োগ দিলাম। সে আপনার সাথে দেখা করতে অনেক আগ্রহী ছিল। তাকে অপেক্ষা করতে বলেছি। সময় হলেই আসবে আপনার সাথে মোলাকাত করতে।

ঃ মানে কি…? এত রহস্য মামুন সর্দারের হজম হচ্ছে না। আশে পাশে হচ্ছেটা কি। নিজের বাড়িতে নিজেকেই বন্দি মনে হচ্ছে। তিনি এক দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে থাকলেন রাশেদের গমন পথের দিকে।

এই সময় মামুন সর্দারে হাতের ফোন বেজে উঠল।

ঃ… ঐ হালারপুত এতক্ষন ফোন দেই কই ছিলি? কি করছস এবার? কার লগে লাগতে গেছস আবার? এই বুইড়া বয়সেও তোর আক্কেল হয় না হারামজাদা?

মামুন সর্দারের আমতা আমতা এখনো কাটেনি, ফোনে বন্ধুর ঝাড়ি খেয়েও কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। হচ্ছেটা কি?

ঃ আমিই তো তোরে ফোন দিসিলাম এমরান… ফোনতো যায়ই না। কি হইছে শোন… মিজি বাড়ির পোলাটা … রাশেদ আইছিল…।

ঃ রাশেদের কথা বাদ দে, সত্যি কইরা ক-ত বাপ এইবার তুই কারে আঙ্গুল দিছস? আমারে গান পয়েন্টে নিয়া এতক্ষন একটা গাড়ির মধ্যে বসায়া রাখছিল। খালি জিগাইল আমি তোর বন্ধু নাকি। আমিতো ভাবলাম সব শেষ, এইবার তোর লগে পাপের শাস্তি আমারেও ভুগতে হবে।

ঃ তারপর কি হইছে?

ঃ… কিছু না, কিছুক্ষন পর আমারে ছাইড়া দিল। একজনও এলাকার কেউ না। পুলিশও না। কইল সোজা হাটা দে। গাড়ি থেকে নাইমে একটা দৌড় দিসি। গুলি করলে হাটলেও খাইতাম দৌড় দিলেও খাইতাম…। আমারে ক… … তুই কি করছস আবার?

ঃ তুই ফোন রাখ, তোরে পরে ফোন দিতেসি। থানার ওসির সাথে একটু কথা বলে নেই। টাকা কি মাগনা দেই তারে?

ওসি সাহেব ফোন ধরলেন না। তার পাঁচ মিনিট পর ফোন ব্যাক করলেন।

ঃমামুন ভাই, আপনি কি বড়সড় কোন ঝামেলা পাকিয়েছেন নাকি? সকাল থেকে খালি বসদের ফোন পাচ্ছি? একটা ছেলে আসল, আপনার ভাতিজা… নাম রাশেদ। আপনার ব্যপারে খবর নিতে।

ঃ আপনি কি বলেছেন? কি জানতে চায় সে?

ঃ আমি কিছুই বলি নাই, সে নিজেই সব জানে … আমার কাছে এসে খালি বলল ঘটনা সত্যি কিনা।

ঃ কিছুই বলেন নাই আপনে? মামুন সর্দারের কন্ঠে হতাশা।

ঃ কসম লাগে, কিছুই বলি নাই। উপর থেকে নির্দেশ ছিল তার সাথে সহযোগিতা করার। এই গ্রামেরই তো ছেলে। আপনার ভাতিজা যে সে না, এইটা আমি তার কথাতেই বুজেছি। কিন্তু সে আর কোন পরিচয় দিতে চায় নাই। খালি বলেছে আপনি নাকি তার ম্যাজিক চুরি করেছেন। মাথামুণ্ড কিছুই বুঝি নাই। বড়লোকের পাগল-ছাগল।

আপনার জন্য আরেকটা দুঃসংবাদ আছে… … হোসেন ডাকাত জামিনে বের হয়ে এসেছে। আপনি কয়টা দিন একটু সেইফে থাকেন। জামিন কে করাইছে তা খোঁজ নিয়া দেখতে হবে।

মামুন সর্দার বসে পড়লেন। কে জামিন করিয়েছে তা তিনি বুঝতে পারছেন। আর হোসেন এখন কি করবে তাও তিনি জানেন। হোসেনের মত লোক বেঈমানি করে না। করে তার মত লোকজন। অনেক বাটপারি, খুন খারাবি করেছেন তিনি, কিন্তু ম্যাজিক চুরির বিষয়টা এখনো বুঝতে পারছেন না । তবে আশেপাশে যা ঘটছে ম্যাজিকের মতই।

তার ঘামাবার পরিমান বাড়ছেই। মনে হচ্ছে বুনো হাতির পাল তার দিকে তেড়ে আসছে আর তিনি ন্যাংটা হয়ে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।

0 Comments

মন্তব্য

দেলোয়ার জাহান

মনের একান্তে কিছু কথা থাকে যা কাউকে বলা যায় না। বলতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খায় আমাকে। সে সকল হাবিজাবি জীবন দর্শন আর কিছু অসময়ের কাব্য নিয়ে আমার লেখালেখির ভুবন।

Pin It on Pinterest

Share This