আমার আমি ৯: ভবিষ্যতের পৃথিবী

Mar 9, 2024আত্মকথন0 comments

বিংশ শতাব্দীর বেকুব তারাই যারা পরিবর্তনের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে না। কথাটা আমার না, বিখ্যাত সাহিত্যিক এলভিন টফলারের। তার সাথে দ্বিমত করার কোন কারন নেই।

আমি ব্যাপারটা নানারকম পরিস্থিতিতে চিন্তা করে দেখেছি, প্রায় সবখানেই মিলে গেছে। বেয়াক্কেল লোকজন আসলেই কিছু শিখতে চায়না। পুরনো বিশ্বাস আর আশা নিয়েই পড়ে থাকে, এবং অবধারিতভাবে নিজের এবং অন্যের ক্ষতি সাধন করে। বুদ্ধিমানের উচিত এই ধরনের লোকজন থেকে দশ হাত দূরে থাকা।

কিছু সময় আমি সেটা পারি, আর বাকি সময় পারিনা। তখন পশ্চাতদেশ পেতে দিতে হয়।

একটা পৃথিবী আসছে আর মাত্র ১০ বছরের মধ্যেই। যেখানে চিন্তাভাবনা আর শিল্প সাহিত্যে হাত দিয়ে ফেলবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। মানুষের থেকে অনেক দ্রুত চিন্তার ক্ষমতা আর বিশাল ব্যাপ্তিতে তথ্য সংগ্রহ এবং বাছাইয়ের ক্ষমতার কারনে আমাদের অনেক কাজেই সহযোগী হয়ে উঠবে সে।

আপনি যদি বুদ্ধিমান বা বুদ্ধিমতী হন, তবে আপনার সন্তানকে এই নতুন পৃথিবীর জন্য তৈরি করবেন এখন থেকেই। গৎবাঁধা নয়টা-পাঁচটা অফিসের জন্য তাকে তৈরি করে লাভ নেই। আর দশজনে কি করছে সেটা শুনে আর দেখে সন্তানকে নিজের মত বেয়াক্কেল বানাবেন না।

অনেক চাকুরীই কেড়ে নেবে এই নতুন প্রযুক্তি। যেমনটা হয়েছে শিল্প বিপ্লবের সময়। কলকারখানায় নতুন মেশিন আসার ফলে রাতারাতি বেকার হয়ে যায় অনেক মানুষ। তাদেরকে চলে যেতে হয় অন্য পেশায়।

একটু পেছনের দিকে ফিরে যাই, অনেক পেছনে। যখন মানুষ জঙ্গলে বা গুহায় থাকত। শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতে হোত। একজন মানুষ একাধারে দক্ষ শিকারী, পাহারাদার আর পরিব্রাজক হোত সেসময়। কারন পৃথিবীর ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে শিকার আর বাসস্থানও বদলাতো তখন। আবার একজায়গায় শিকার পাবার সম্ভাবনা কমে গেলে সবাই অন্যজায়গায় চলে যেত।

চাষাবাদ আবিষ্কারের পর মানুষ শুধু শিকারের উপর নির্ভর করা বাদ দিয়ে এক জায়গায় বসতি স্থাপন শুরু করল। শেখা শুরু হোল কৃষি প্রযুক্তি। সভ্যতার গোড়াপত্তন হোল তখন।

“সার্ভাইবাল অব দ্যা ফিটেস্ট” এর দুনিয়ায়, প্রত্যেক মানুষকে তখন কয়েকটা জিনিস জানতে হোত। নারী-পুরুষ উভয়েই তখন জানত আগুন জ্বালানো, শিকার করা, চাষাবাদ, রান্না করা, কাপড় বোনা – ইত্যাদি। মানুষের সভ্যতা যত এগিয়েছে কাজের শ্রমবিভাগ তত বেড়েছে। নিজের জুতো কালি করা বা জামাকাপড় ধোয়ার জন্যও আমাদের আলাদা পেশাজীবী শ্রেনী আছে এখন।

কিছু জিনিস এখনও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার জানা থাকা দরকার, যেটা মানুষের “সার্ভাইবাল টেকনিক” – এর মধ্যে পড়ে। যেমন, রান্না করতে পারা, গাড়ি চালানো, সাঁতার ইত্যাদি। আমি কৃষির কথাও বলতাম, কিন্তু বাজার ব্যবস্থাপনার উন্নতির ফলে এখন আর আপনাকে নিজের খাবার নিজে ফলাতে হয় না। অন্তত সমাজের বেশ বড় একটা অংশের সেটা আর করতে হয় না।

কিন্তু রান্না করাটা আপনাকে শিখতেই হবে। এটা বেঁচে থাকার জন্য দরকার। আপনার সন্তানের ভবিষ্যতের দিকে তাঁকিয়ে দয়া করে তাকে রান্নার ট্রেনিং দিন। ছেলে হোক বা মেয়ে, তাকে এটা শেখানো জরুরী। পরিচ্ছন্নতার শিক্ষাও সে রান্না শিখতে গিয়ে পেয়ে যাবে।

বছর দুয়েক আগেও আমি মনে করতাম বাচ্চাদের কোডিং শেখানোটা জরুরী। ভবিষ্যতের পৃথিবীতে এটা খুব জরুরী একটা স্কিল হয়ে দাঁড়াবে। আমি সেই ধারনা থেকে সরে এসেছি। AI যেরকম নির্ভুল ভাবে স্বল্প সময়ে যে কোন কোড লিখতে পারছে, সেখানে মানুষের এখন কষ্ট করে লাইনের পর লাইন কোড লেখার দরকার নাই। আমাদের দরকার বাচ্চাদের যুক্তি শেখানো। সে যেনো যৌক্তিক চিন্তা করে AI কে নির্দেশনা দিতে পারে, কি ধরনের কোড সে আউটপুট পেতে চাচ্ছে।

একটা AI ঠিক ততটাই নির্ভুল কোডিং করতে পারবে ঠিক যতটা যৌক্তিকভাবে আপনি তাকে বলতে পারবেন, কি ধরনের কাজ আপনি চাইছেন।

আমাদের Gen-Z কে মোটামুটিভাবে ভাগ্যবান বলা চলে। যে সকল রোগের চিকিৎসার জন্য আমরা লাখ লাখ টাকা খরচ করেও সময় নষ্ট করে চলেছি হাসপাতালের বারান্দায়, এগুলোর চিকিৎসা বা প্রতিষেধক চলে আসছে আর মাত্র ১০ বছরের মধ্যেই। শুধু দরকার অল্প কিছু প্রতিষ্ঠানের উপর নজরদারী করা এবং বিগফার্মা কোম্পানীগুলোর একতরফা ব্যবসা বন্ধ করার জন্য আইন তৈরি করা।

কি হবে ভবিষ্যতে তা অনুমান করাটা সোজা, কিন্তু পুরো পৃথিবীর দিকে তাঁকালে সে দৃশ্যপট হুট করে বদলে যাওয়া আমরা বেশ অনেকবার দেখেছি। আরেকটা বিশ্বযুদ্ধ বদলে দিতে পারে পৃথিবীর মানচিত্র কিংবা প্রযুক্তির চলার পথ।

তবে ভবিষ্যতের এলিট শ্রেনীর মানুষদের কিছু বিষয়ে দক্ষতা অবশ্যই থাকা লাগবে, প্রযুক্তির জ্ঞান তার মধ্যে প্রধান। আপনার সন্তানকে কম্পিউটার টেকনোলজি, গেইমিং, ডিজাইনিং, লজিক্যাল থিংকিং এসকল বিষয়গুলোতে ছোট থেকেই ট্রেইন করা শুরু করুন। প্রথাগত পড়াশোনা যেহেতু একদিনেই চলে যাচ্ছে না বা বদলে যাচ্ছে না, যে বিদ্যাগুলো আসলেই কাজে আসবে সেগুলো আগে থেকেই শিখিয়ে রাখা দরকার।

আমরা সব কাজে সফল হবার জন্য তৈরি হইনি। আমাদের মস্তিষ্ক এমনভাবে উন্নত হয়েছে, যা আমাদের আশেপাশের পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে বেঁচে থাকতে সাহায্য করতে পারে। খাদ্যের অভাব না হলেই শুধুমাত্র আমরা শিল্প-সাহিত্যের কদর করতে পারি। অনুন্নত রাষ্ট্র তাই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করার থেকে কেনায় বেশি মনযোগী হয়।

অবশ্যম্ভাবী ভাবেই ভবিষ্যতের দুনিয়া হতে যাচ্ছে প্রযুক্তির। সে আপনার সন্তানের প্রতিযোগী হবে না সহযোগী, তা নির্ভর করবে আজকে আপনি তাকে কি শেখাচ্ছেন তার ওপর!

0 Comments

মন্তব্য

দেলোয়ার জাহান

মনের একান্তে কিছু কথা থাকে যা কাউকে বলা যায় না। বলতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খায় আমাকে। সে সকল হাবিজাবি জীবন দর্শন আর কিছু অসময়ের কাব্য নিয়ে আমার লেখালেখির ভুবন।

Pin It on Pinterest

Share This