আলিনা অধ্যায় ২০: বন্দী পরবাস

Jan 23, 2024আত্মকথন0 comments

।। এক ।।

আলিনা নতুন ক্লাসে উঠেছে, বেশ আনন্দের খবর। এখনও পর্যন্ত পরীক্ষা, তার ফলাফল এবং সেটা নিয়ে দুঃশ্চিন্তা তার মধ্যে দেখা যায়নি। এটা বেশ ভালো হয়েছে। কারন এসকল ব্যাপারে আমি বেশ ফুরফুরে মনোভাবে থাকি। কোনভাবেই তাকে বুঝতে দেইনা স্কুলের পরীক্ষায় খারাপ করলে আমার মন খারাপ হবে।

সাধারন পরীক্ষা নিয়ে অভিভাবকদের যে রকম হা-হুতাশ করতে দেখি, সেটা দেখলে মনে হয় তার বাচ্চা জীবন-মরন পরীক্ষা দিতে বসেছিল। অথচ তুচ্ছ এই বিষয়গুলো বড় হবার পরে হাস্যকর মনে হয়।

এ ধরনের বিষয়গুলোতে আমার উদাসীনতা দেখে অনেকেই ভাবে আমি মনে হয় বাচ্চার পড়াশোনা নিয়ে ভাবিনা। আমি ভাবি কিন্তু বুঝতে দেইনা। নিজের যন্ত্রনা, অহেতুক উদ্বিগ্নতা শিশুদের মাঝে ছড়িয়ে দেবার কোন প্রয়োজন আমি বোধ করি না। যেকটা দিন পারুক নিশ্চিন্তে কাটিয়ে যাক।

তবে হতাশার বিষয় হচ্ছে আলিনা নিজে তার স্কুলে গিয়ে পরীক্ষার ফলাফল আনতে পারেনি। সে কাজটা তার হয়ে দাদু আর চাচ্চু করেছে। নতুন বইও নিজে সংগ্রহ করতে পারেনি। এই দুটো বিষয় আমার কাছে উৎসবের মত লাগে।

আলিনাকে নিয়ে দেশের বাইরে আছি প্রায় একমাস হতে চলল। এবারে আনন্দ ভ্রমন না হওয়াতে বেশ বেকায়দায় আছে মেয়েটা। হাসপাতাল আর বাসা করেই কেটে গেছে বেশ অনেকগুলো দিন। বুঝতে পারছি সে “বোরড” হয়ে যাচ্ছে। তবে মা সাথে থাকায় এখানেও মানিয়ে নিতে পারছে মেয়েটা। আমরা গরমের দেশের মানুষ, দিল্লীর এই সময়ের ঠান্ডা তাপমাত্রায় ভালো থাকার আপ্রান চেষ্টা করছি।

শিশুরা খুব দ্রুত নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারে। পারে না বুড়ো ধাড়িরা। তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামলেই আমার হাঁড় কাঁপাকাপি শুরু হয়ে যায়। কিন্তু আলিনাকে দেখি দিব্যি মোবাইল দেখছে।

এর মাঝখানে ফেইসবুকে দেখলাম, পাঠ্যপুস্তক আর শিক্ষানীতিতে পরিবর্তন আনায় – একটা মহল বেশ খেপেছে। জায়গায় বেজায়গায় তারা জ্বালাময়ী ভাষন দিয়ে বোঝাচ্ছে আগের পদ্ধতিই ভালো ছিলো।

আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে নতুন শিক্ষানীতি দেখলাম। খারাপ কিছু খুঁজে পাইনি। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে পরিবর্তন আসবেই। যদি পরিবর্তন মেনে নিতে না পারেন তবে হারিয়ে যাবেন। আমাদের পূর্ব পুরুষ কুয়ার ব্যাঙ হয়ে ছিলো দেখে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও যে একই রকম থাকতে হবে এরকম কোন কথা নেই।

এটা অবশ্যম্ভাবী যে নদীর স্রোত, সংস্কৃতি, ভাষা আর জ্ঞান – এগুলো আটকে থাকে না। কোন না কোনভাবেই তা প্রকাশিত হবেই।

একটা বিশাল মূর্খ জনগোষ্ঠী সামনে যাবার বদলে, মানসিকতায় পেছনে যাচ্ছে, এটা দেখতে ভালো লাগে না। তবে ইতিহাস বলে এই দল সবসময়ই পরাজিত হয়েছিল। শুধু দরকার যথেষ্ট সময়ের। দরকার প্রাথমিক আর মাধ্যমিকের শিক্ষার পেছনে বিশাল অংকের বাজেট করা।

।। দুই ।।

আলিনা অধ্যায় ২০: বন্দী পরবাস 1

আমার পাশে বসে গেইম খেলতে খেলতে আলিনা বলছে, বাবা আমার মনে হচ্ছে আমরা একটা প্রিজনে আছি।

আমি হাসলাম। বললাম, এটাকে কি জেলখানা বলে? তুমি যখন খুশি বাইরে যেতে পারছ। যা খুশি খেতে পারছ, মোবাইলে গেইম খেলছ? এটাকে প্রিজন কিভাবে বলে?

– না মনে হচ্ছে বড় একটা জেলখানা। যেখানে তুমি অনেক কিছু করতে পারো, কিন্তু আবার সব কিছু করতে পারো না।

– এটাকে বলে কম্ফোর্ট জোনের বাইরে বের হওয়া। তুমি জীবনে যতবার তোমার পরিচিত গন্ডি আর আরামের জায়গা ছেড়ে বের হবে, তুমি নতুন কিছু শিখবে।

আলিনা আমার সহজ করা বলা, কঠিন দার্শনিক কথার কোন জবাব দেয় না। তার পরিচিত ঘুমানোর বিছানা নেই, খেলার জন্য স্কুলের বারান্দা নেই, চেনা কম্পিউটার নেই, অসময়ের আবদার রক্ষা করা নেই – অনেক কিছু ছেড়ে দিয়ে আমরা এই পরবাসে কেন পড়ে আছি, সেটা নিয়েও তার পুরো ধারনা নেই। তবে আমি জানি অবচেতনে সে অনেক কিছু শিখছে। শিশুদের শেখাটা এমনই হয়। তারা দেখে শেখে, নিজের মত করে দুইয়ে-দুইয়ে চার মেলায়। আমরা বড়রা তাদের জোর করে শেখাতে গিয়ে প্রকৃতি প্রদত্ত্ব প্রশ্ন করার ক্ষমতাটা কেড়ে নিই। শিশুরা হারিয়ে ফেলে তাদের বৈজ্ঞানিক মন।

একটা বাচ্চা কিন্তু ছোট থাকতে প্রশ্ন করে, ঘাসের রঙ নীল না হয়ে সবুজ কেন? বৃষ্টি কেন পড়ে, বাতি কিভাবে জ্বলে? কিংবা – ইন্টারনেট কিভাবে আসল… ইত্যাদি। স্কুল পার হতে না হতেই তাদের এই জিজ্ঞাসু মনোভাবের পরিসমাপ্তি ঘটে। আমরা তাদের গাধার মত খেটে চাকুরী পাবার লোভনীয় রাস্তায় নিয়ে আসি।

সমস্যা বাচ্চাদের নয়, আমাদের শেখানোর পদ্ধতিতে। পৃথিবীজোড়া পাঠাশালার ছাত্র হবার থেকে আমরা তাকে শিখিয়ে দেই কিভাবে কেরানী হবার দৌড়ে এগিয়ে যেতে হবে সেটা।

আলিনার এবারের জন্মদিন খুব নিরানন্দ গেছে। কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি। আমরা যেখানটায় আছি, সেখানে ঘোরার খুব বেশি জায়গাও নেই। শেষবেলায় তাকে বার্গার খেয়েই কাটাতে হয়েছে। তবে সে এবার Macaron নামে একটা বিস্কিটের আবদার করেছিল। সেটা তাকে এনে দিয়েছি। আমার বাপের জন্মেও এত সুন্দর দেখতে অখাদ্য বিস্কিট খাইনি। প্রচন্ড মিষ্টি আর দামও বেশ চড়া। এইদামে একটা এক পাউন্ডের চকোলেট কেক পাওয়া যায় ঢাকায়।

আলিনা অধ্যায় ২০: বন্দী পরবাস 2

এই বিস্কিটের নাম অবশ্যই সে ইউটিউব দেখে জেনেছে এবং সেখান থেকেই তার খাবার লোভ হয়েছে। দুনিয়ায় যে অনেক আজব আজব খাদ্য আছে সেটা আমার কন্যা মাঝে মাঝে আমাকে শেখায়।

শিশুদের কাছ থেকে শিখতে আমার কোন লজ্জা হয়না।

চিলির নোবেল বিজয়ী বিখ্যাত কবি এবং রাজনীতিবিদ পাবলো নেরুদার একটা কবিতা আছে, সেটা আজকে আবার চোখের সামনে আসল। জীবনের সংজ্ঞা যদি খুঁজতে থাকেন তবে এখানেই খুঁজে পাবেন।

You start dying slowly
if you do not travel,
if you do not read,
If you do not listen to the sounds of life,
If you do not appreciate yourself.

You start dying slowly
When you kill your self-esteem;
When you do not let others help you.

You start dying slowly
If you become a slave of your habits,
Walking everyday on the same paths…
If you do not change your routine,
If you do not wear different colours
Or you do not speak to those you don’t know.

You start dying slowly
If you avoid to feel passion
And their turbulent emotions;
Those which make your eyes glisten
And your heart beat fast.

You start dying slowly
If you do not change your life when you are not satisfied with your job, or with your love,
If you do not risk what is safe for the uncertain,
If you do not go after a dream,
If you do not allow yourself,
At least once in your lifetime,
To run away from sensible advice…

0 Comments

মন্তব্য

দেলোয়ার জাহান

মনের একান্তে কিছু কথা থাকে যা কাউকে বলা যায় না। বলতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খায় আমাকে। সে সকল হাবিজাবি জীবন দর্শন আর কিছু অসময়ের কাব্য নিয়ে আমার লেখালেখির ভুবন।

Pin It on Pinterest

Share This