আলিনা অধ্যায় -১৫: সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি

Nov 23, 2022আত্মকথন0 comments

|| এক ||

মানুষের জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ন বিষয় হোল তার সময়। আমাদের সময় খুব সীমিত, কিন্তু আমরা তা বুঝতে চাই না। আমাদের সময় কেটে যায় জীবনের তুচ্ছ সব হিসেব নিকেষ করতে গিয়ে। একটা সময় গিয়ে আমরা যখন বুঝতে পারি প্রিয়জনের সাথে আরেকটু বেশি সময় কাটানোর দরকার ছিল, ততক্ষনে অনেক দেরি হয়ে যায়। সবাই চারদেয়াল তুলে রেখে দেয় চারপাশে। অচেনা সেই দেয়াল ভাঙ্গার সময় আর সাধ্য আমাদের কারো হয় না।

আমি যতটা বেশি সময় আমার কন্যার সাথে থাকতে চাই, ততটা পারিনা। তার নিজের জগত আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। বড় হবার সবচেয়ে খারাপ জিনিস হচ্ছে শৈশবের প্রিয় মানুষদের সাথে দূরত্ব বেড়ে যাওয়া। একদিন আমার ছোট্ট রাজকন্যার জীবনে এমন অনেক কিছুই ঘটবে, যা সে আমার সাথে আর ভাগাভাগি করতে চাইবে না। দৌড়ে এসে ক্লাসরুমের ব্যাঙ আর প্রজাপতি দেখার গল্প বলবে না, আবদার করবে না নতুন কাগজ আর পেন্সিল কিনে দেবার।

আমি সেই দিনের প্রতীক্ষায়। সন্তান বড় হবে, মায়া ফেলে রেখে যাবে। আর কিছু স্মৃতি রয়ে যাবে আমার বুকের বাঁ পকেটে।

প্রথম শ্রেনীর বার্ষিক পরীক্ষা প্রায় সমাগত। করোনার দীর্ঘকাল অনলাইনে ক্লাস করেও আলিনা বেশ লম্বা সময় স্কুলে যেতে পেরেছে। তার স্মৃতির ঝুলিতে যোগ হয়েছে অনেক নতুন কিছু। মানব মস্তিষ্কের রহস্যময়তায় জীবনের কোন এক সময় সে তা বের করে নিয়ে আসবে আবার। আমাদের জীবন কি বিশাল বিস্ময়ের আমরা তা অনুধাবনই করতে পারিনা। এই বেঁচে থাকাটাই এক অদ্ভুত সুন্দর।

অসীম মহাবিশ্বে প্রানের অস্তিত্ব যেমন একটা বিস্ময়ের জিনিস, আমাদের জীবনের এই ছোট ছোট স্মৃতিগুলোর হঠাৎ করে আবার ফিরে আসাটাও তেমনি বিস্ময়ের।

এরই মাঝখানে আবার একবার ফুটবল বিশ্বকাপ (২০২২) চলে এসেছে। বয়সের কারনে আগের মতো করে সেই উন্মাদনা আর দেখাই না। আমি নিজে ব্রাজিল সমর্থক, কিন্তু খেলা দেখার সুযোগ হবে কিনা জানি না। জাগতিক উন্মাদনায় ইদানিং কেমন যেন একটা বৈরাগ্য এসে যাচ্ছে।

কন্যাকে জিজ্ঞেস করলাম “তুমি কোন দল সাপোর্ট করবে?” যদিও আমি জানি ফুটবল খেলা সে কোনভাবেই বোঝে না। ফুটবল চিনলেও এটা তার আগ্রহের কোন বিষয় নয়।

আলিনা আমার কথার জবাব দিলোনা। আমি আবার বললাম –
ঃ বাবা কিন্তু ব্রাজিলের সাপোর্টার, তোমাকে একটা ব্রাজিলের জার্সি কিনে দেই? … তাহলে তুমিও ব্রাজিলের সাপোর্টার হয়ে যাবে।

ঃ কিন্তু বাবা… আমাদের স্কুলের সবাই , এমনকি ক্লাসের সবাই আর্জেন্টিনা করে।
ঃ কিভাবে বুঝলে তুমি? ওরা বলেছে তোমাকে…।
ঃ… হ্যাঁ … শুধু তিনজন ব্রাজিলের সাপোর্ট করে… আর দেখোনা আমাদের ড্রেস নীল আর সাদা… তার মানে স্কুলের সবাই আর্জেন্টিনা করে।

আমি আলিনার যুক্তিতে চমৎকৃত। ব্যপ্যারটা সারকাজমের পর্যায়ে চলে গেছে। নীল সাদার একদল শৈশব ঘুরে বেড়ায় আর্জেন্টিনার সাপোর্টার হয়ে।

আলিনা অধ্যায় -১৫: সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি 1
ইউটিউব দেখা বিদ্যায় যখন আলিনা সুশি খেতে চায় –

|| দুই ||

বাচ্চার স্কুলের নিয়মিত যাতায়াত আছে আমার। সেই সুবাদে অনেক অভিভাবকের সাথেই আমার পরিচয় হয়েছে। এরা সমাজের বিভিন্ন পেশার এবং স্তরের মানুষ। আমি সময় সুযোগ পেলে তাদের সবার কথাই মনযোগ দিয়ে শুনি। একটা বিষয় খুব আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম এরা মেয়েদের চাকরি, গবেষনা আর দেশ চালানোর নানা বিষয়ে এখনও মধ্যযুগীয় ধারনা পোষন করে। কিন্তু নিজের মেয়ে বাচ্চাটাকে ঠিকই স্কুলে নিয়ে আসছে। অথচ দরকার ছিল নিজের মেয়ে বাচ্চাটিকে যেভাবে দেখেন, সেভাবেই যেন অন্য নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা আর সমর্থন থাকে।

আমাদের মানসিকতার অনেক পরিবর্তন বাকি। হয়ত আরো কয়েক প্রজন্ম লাগবে। একটা দেশ বদলাতে তার তরুন সমাজের যে ভূমিকা তার থেকে বেশি ভূমিকা রাখতে পারে এই মানুষেরা, যারা তরুন হয়ে ওঠার আগে সন্তানের সামনে কুসংস্কারের বদলে সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে।

পড়াশোনার ব্যাপারে অতি উৎসাহী হয়ে ওঠা অভিভাবক দেখি প্রতিনিয়ত। এরা বাচ্চাকে প্রথম বেঞ্চিতে বসানো নিয়ে রীতিমত অলিখিত একটা যুদ্ধ চালায়। প্রথম বেঞ্চিতে বাচ্চা বসতে পারলেই যেন সে জীবন দৌড়ে এগিয়ে যাবে।

আমি বাচ্চাকে স্কুলে দিয়েছি উপভোগ করার জন্য, সেই সাথে কিছুটা শিক্ষা। কখনো চাইনা আমার সন্তান এরকম একটা দৌড় প্রতিযোগিতায় নেমে যাক। তার যদি ইচ্ছা থাকে সে বড় হয়ে অনেক কিছুই হতে পারবে। সেই ইচ্ছেটাই জেগে উঠুক সেই দোয়া করি।

ক্লাসে কিছু দুষ্ট বাচ্চা থাকে। তারা চঞ্চল হয়, কিছু বাচ্চা থাকে খুব ডমিনেট করতে চায় অন্যদের। এ নিয়ে বেশ সমস্যাও হয়ে গেছে। ক্লাসরুম আর স্কুলের বারান্দা পেরিয়ে তা একসময় চলে আসে অভিভাবক মহলে। প্রথম শ্রেনীর এক বাচ্চার মা আরেক বাচ্চার মায়ের সাথে তুমুল তর্কে লিপ্ত হয়।

অথচ একদিন পরেই দুই বাচ্চার আবার গলায় গলায় ভাব। কিন্তু তাদের অভিভাবকেরা ট্রয়ের যুদ্ধে নেমে যায় পান থেকে চুন খসলেই। বিদ্যালয় যে একটা জীবনের পাঠ নেবার জায়গা সেটাই ভুলে যায় সবাই। পাঠ্যবইয়ের সাথে সাথে জীবনের আরো অনেক কিছু আয়ত্ব করা শেখানোর জন্যই স্কুল।

আমাদের স্কুলের অভিভাবকদের আবারো স্কুলে পাঠানো দরকার। এরা অনেকেই মানসিকভাবে ব্যাধিগ্রস্থ। যদি আপনি উদার না হন, উদারতা আর পরমত সহিষ্ণুতা না দেখান, তবে আপনার সন্তানও বড় হতে হতে সেটা শিখবে না।

আপনার হিংসা আর ক্রোধ আপনি রেখে যাচ্ছেন আরেক প্রজন্মের কাঁধের উপর। আপনি ডাক্তার হতে পারেন নাই বলে আপনার সন্তান কেন আপনার না পূরন হওয়া স্বপ্ন পূরন করবে? তাকে জিজ্ঞেস করুন তার নিজের স্বপ্নের কথা, সে কি হতে চায়।

অহেতুক নিজের অবদমিত ইচ্ছা সন্তানের উপর চাপিয়ে দিয়ে তাকে মানসিকভাবে পঙ্গু করে দেবেন না। আসুন ঘৃনার পরিবর্তে মায়া ছড়িয়ে যাই।

ভাল থাকুক তারার সন্তানেরা এই সূর্যের নিচে।

0 Comments

মন্তব্য

দেলোয়ার জাহান

মনের একান্তে কিছু কথা থাকে যা কাউকে বলা যায় না। বলতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খায় আমাকে। সে সকল হাবিজাবি জীবন দর্শন আর কিছু অসময়ের কাব্য নিয়ে আমার লেখালেখির ভুবন।

Pin It on Pinterest

Share This