সার্গেই প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে তার সেক্রেটারির দিকে তাঁকালেন। মেয়েটা চুপসে গেছে। কিন্তু খারাপ খবরটা সকাল সকাল দিতেই হবে। নিরাপত্তা পরিষদের সভায় উপস্থিত না থাকতে পারলে সার্গেইকে জবাবদিহি করতে হবে। আর তাকে না জানালে লিডিয়াকে। লিডিয়া শুধু সংবাদ বাহক মাত্র।
এদিকে সার্গেই ভ্রু কুঁচকে তাঁকিয়ে আছেন সামনে রাখা ব্ল্যাক কফি কাপের দিকে। চুমুক দিতে ভুলে গেছেন। লিডিয়া তার নির্দেশের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। তিনি হাত নাড়িয়ে তাকে চলে যেতে বলার পরও সে দাঁড়িয়ে রইল।
– আর কি চাও?
– মানে আমাকে জানাতে বলেছে আপনি যাবেন কিনা?
– চাকরি যখন করি তখন হুকুম তামিল করাই গোলামের কাজ। যেতে বলেছে যাবো। এখন তুমি যাও। আমি বউকে ফোন করে খুশির খবরটা দেই। সে নিশ্চয়ই খুব আহ্লাদিত হবে শুনে।
লিডিয়া হাসি আটকে রেখে গম্ভীরভাবে রুম থেকে বিদায় নিলো। বসের বিবাহ বার্ষিকী আগামীকাল। নিশ্চয়ই বউকে নিয়ে ঘুরতে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এই সময় জরুরীভাবে সবার ছুটি বাতিল করা হয়েছে। জরুরীভাবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের মিটিং ডাকা হয়েছে। রাশিয়ান ডিফেন্স সেক্রেটারি হিসেবে তাকে অবশ্যই যেতে হবে। প্রেসিডেন্ট নাও যেতে পারেন। তিনি বর্তমানে ভারত সফরে আছেন।
সার্গেই তার বউকে ফোন দিলেন।
– কি করো, ডার্লিং।
– এইতো, তেমন কিছু না। টিভি দেখছিলাম। এলিয়নদের পৃথিবী আক্রমনের উপর টকশো হচ্ছে। তুমি হটাৎ ফোন দিলে যে, সবকিছু ঠিক আছে? আসলেই কি আমরা আক্রান্ত হচ্ছি?
– না, ঠিক নেই। নিরাপত্তা পরিষদের মিটিং ডেকেছে জাতিসংঘের। আজকেই যেতে হবে। আমাদের বিবাহ বার্ষিকীর প্ল্যান ক্যান্সেল করতে হচ্ছে।
আনা কিছু বলল না ওপাশ থেকে। কি যেন ভাবছে।
– প্রেসিডেন্টতো দেশে নাই, মানে আমাকে যেতেই হবে। না গেলে চাকরি থাকবে না।
– বুঝেছি…। আনা ছোট্ট করে বলল। তবে আমি চাইলে সাথে যেতে পারি, তাই না? তাহলে তুমি তোমার কাজও করতে পারবে আর আমরা পরে ঘুরতেও পারব। নিউইয়র্ক দেখা হয়নি আমার।
– ঠিকাছে, তুমি বাক্স-পেটরা গোছাও আমি কাজ শেষ করে আসছি।
আনার মন ভাল হয়ে গেলো। যাক বিদেশ ট্যুর তো হচ্ছে। এদিকে সার্গেই একের পর এক ফোন করে যাচ্ছেন। ঘটনা কতদূর গড়িয়েছে জানার জন্য।
প্রথমদিন ব্যপারটা অনেক রোমাঞ্চকর ছিল। মানুষ প্রথমবারের মত ভীনগ্রহের প্রানীর দেখা পেয়েছে। না… মানুষ খুঁজে বের করতে পারেনি। যতদুর জানা গেছে এরা হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের একটু বাইরে সাগরে নিজেদের স্পেসশীপ নিয়ে ল্যান্ড করেছে সাগরের মাঝে। এইতো চারদিন আগের কথা মাত্র। পৃথিবীজুড়ে শোরগোল পড়ে গেল। কোন রাডার, স্যাটেলাইট আর আকাশ প্রতিরক্ষা যন্ত্র ধরতে পারেনি, তারা কিভাবে পৃথিবীতে ঢুকেছে। প্রেসিডেন্ট তখন আমেরিকা সফর শেষে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন। জটিল একটা আঞ্চলিক যুদ্বের মধ্যে জড়িয়ে যাচ্ছে আমেরিকা আর চীন। সেটা থামান দরকার। মাঝপথে তাকে জানানো হলো। তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, এটা মনে হয় আমেরিকানদের একটা চাল। যা করার সার্গেই নিজেই যেন করে।
সার্গেই পড়েছে মহা মুসিবতে। পৃথিবীজুড়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগে লাগে অবস্থা, এইসময় এইরকম উটকো ঝামেলা…। সারা পৃথিবীর টিভি আর নিউজ চ্যানেলগুলো প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় আপডেট দিচ্ছে। শ’খানেক হেলিকপ্টার হাওয়াই এর আশেপাশে ঘুরছে। কিন্তু খুব বেশি কাছে যাবার অনুমতি তাদের দেয়নি আমেরিকান নৌবাহিনী। ডজন খানেক স্যাটেলাইট তাক করা আছে সমুদ্রের উপর এদের স্পেশশীপের দিকে।
নিরাপত্তা পরিষদের সভা বসেছে। জরুরী সভা ডাকায় অনেক দেশের প্রেসিডেন্টই আসতে পারেননি। তবে তাদের প্রতিনিধি পাঠিয়েছেন। সাধারণত নিরাপত্তা পরিষদের সভায় সব দেশকে ডাকা না হলেও, এই সভায় জাতইসংঘের সব সদস্য দেশকেই তাদের প্রতিনিধি পাঠাতে বলা হয়েছে। সভাকক্ষ কানায় কানায় পরিপূর্ন।
সভাপতি মার্কেল ফরাসি। তিনি পড়াশোনা করেছেন আমেরিকায়। বিশুদ্ধ ইংরেজিতে শুরু করলেন-
– যারা আজকে এই অল্প সময়ের মধ্যে এখানে আসতে পেরেছেন সবাইকে ধন্যবাদ। এই বিশেষ অধিবেশনে আমরা কেন এসেছি আপনারা সবাই ইতিমধ্যে জানেন। আপনাদের নিজ নিজ দেশের ইন্টেলিজেন্স থেকে আশা করি অবহিত হয়েছেন মানব জাতি একটা চরম বিস্ময়কর মূহুর্তের সম্মুখীন হয়েছে। আমরা প্রথমবারের মত এলিয়েনদের সাথে সাক্ষাত করতে পেরেছি এবং সেটা এই পৃথিবীর বুকেই।
ঘটনা তাহলে সত্য। সার্গেই নিজের লোকজনের উপর কিছুটা বিরক্ত হলেন। তাকে পুরো বিষয়ের ব্রিফ করতে পারেনি রাশিয়ান ইন্টেলিজেন্স। তার আগেই আমেরিকানরা পুরো এলাকা বন্ধ করে ফেলেছিল।
– আমাদের পরবর্তী করণীয় কি? এরা কি বা কোথা থেকে এসেছে সেরকম কিছু বলেছে? সার্গেই উৎসুকভাবে জানতে চাইলেন।
– তার আগে আমাদের জানা দরকার আমেরিকান বন্ধুরা কি মনে করেন তারাই একমাত্র সব কিছুর দাবিদার, আর আমরা বাদ বাকিরা কিছুই না? চায়নিজ ডেলিগেট প্রশ্ন করলেন।
আমেরিকান জেনারেল স্মিথ যিনি এই মিটিং এ আমেরিকার প্রতিনিধিত্ব করছেন তিনি কিছুটা বিরক্ত হলেন এই প্রশ্ন শুনে। নাক বোঁচা চাইনিজরা সবসময়ই সব কিছুতে রাজনীতি করতে চায়।
– না। এরকম কিছু মনে করছি না। নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য বাদেও আজকে মিটিং এ আরো অনেককে ডাকা হয়েছে। এটা পৃথিবীর সবার সমস্যা আমাদের একার না। আমাদের নৌবাহিনী কাছাকাছি ছিলো তাই আমরা সমুদ্রের এই এলাকা ঘিরে রেখেছি। সবার নিজের নিজের স্যাটেলাইট আছে সেখান থেকে সবাই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন করছেন। আপনারা যা জানেন আমরাও তাই জানি।
– স্যাটেলাইটে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। চাইনিজ ডেলিগেটের কন্ঠে ক্ষোভ।
– সেটা আমাদের সমস্যা নয়। চায়নিজ স্যাটেলাইট কেন কাজ করছে না সেটা আপনারাই ভালো জানেন। সবকিছুতেই রাজনীতি টানবেন না।
সভায় একটু গুঞ্জন উঠল। সবাই জানাচ্ছে কারো স্যটেলাইটই ঐ বিশেষ এলাকার ডাটা সংগ্রহ করতে পারছে না।
সভাপতি হাত তুলে সবাইকে থামালেন।
– বন্ধুগন আমরা আজকে এখানে কোন জাতিগত দাঙ্গা নিয়ে আলোচনা করতে আসিনি। আমাদের একটা জরুরী দরকারে এক হয়েছি।
– কি সেটা? সার্গেই জানতে চাইলেন।
সভাপতি সবার মুখের দিকে একটু তাঁকালেন। লম্বা নিঃশ্বাস নিলেন। তিনি বুঝতে চাইছেন এর পরের প্রতিক্রিয়া কি হবে তার কথা শুনে।
– আমরা ওদের সাথে যোগাযোগ করতে পেরেছি। আমাদের অতিথিরা তাদের প্রতিনিধি পাঠিয়েছেন মানুষের সাথে কথা বলার জন্য। আজকের সভা এই কারনেই ডাকা।
– কোন অতিথি? সার্গেই এর মুখ বিস্ময়ে ঝুলে গেছে।
– মুখ বন্ধ করুন, মাছি ঢুকে যেতে পারে সিনর। ম্যাক্সিকান ডেলিগেটদের একজন টিপ্পনি কাটলেন। সভায় পিনপতন নিরবতা নেমে এসেছে।
– আজকে এখানে সবার একত্রে আসার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাদের ভিনগ্রহের অতিথিদের সাথে কথা বলা। ওনারা অপেক্ষা করছেন। এখানেই আছেন। ওদের নিয়ে আসুন। পরের আলোচনা তাদের সামনেই হবে। সব দেশের প্রতিনিধিদের শোনার দরকার আছে কি নিয়ে আলোচনা হয়। মার্কেল শুন্যে হাতের ইশারা করলেন।
হলরুমের দরজা খুলে তিনজন মানুষের আকৃতি ঢুকলো। সবুজ আলখেল্লার মত একটা বস্তুতে তাদের সমস্ত শরীর ঢাকা। মাথায় চুলের পরিবর্তে ক্যাকটাসের কাঁটার মত কিছু অংশ। চোখের জায়গাটা অনেক বড় আর দেখতে অক্টোপাসের চোখের মত অনেকগুলো চোখ। শরীরের যতটুকু অংশ দেখা যাচ্ছে পুরোটাই সবুজ।
হতবিহব্বল সবার সামনে দিয়ে গিয়ে তারা সভাপতির সামনের নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে বসলেন। যেহেতু তাদের পা দেখা যাচ্ছে না তাই এই প্রানীরা হেঁটে এলো নাকি ভেসে ভেসে তা নিয়ে অনেকেই সন্দেহ পোষন করছে। সভার গুঞ্জন আস্তে আস্তে বাড়ছে।
– আপনারা সবাই একটু শান্ত হোন। দয়া করে কেউ চিৎকার চেঁচামেচি করবেন না। আমরা চাইনা অতিথিদের সামনে পৃথিবীর সম্মান নষ্ট হোক। আপনাদের কোন প্রশ্ন থাকলে লিখে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন। আমি নিজে থেকে এগুলো তাদের জিগ্যেস করব। তার আগে চলুন শুনি আমাদের ভিনগ্রহের বন্ধুরা কি বলতে চান।
তিনজনের একজন উঠে দাঁড়াল তারপর একটা হাত উপরে তুলে বলা শুরু করল। সবাই অবাক হয়ে শুনতে পেল এরা পরিষ্কার ইংরেজী বলছে।
– সুপ্রভাত পৃথিবীবাসী। আশা করি সবাই সুস্থ আছেন। এত অল্প সময়ের মাঝে আপনাদের সাথে দেখা করতে পেরে আনন্দিত। আমরা একই গ্যালাক্সির অধিবাসী। গ্যালাক্সির প্রায় শেষ প্রান্তে আপনাদের থেকে বেশি বয়সের একটা তারার সিস্টেমে আমাদের বাস। পৃথিবীর হিসেবে চারদিন আগে আমরা আপনাদের সাগরে অবতরন করেছি। অনুপ্রবেশের জন্য আমরা দুঃখিত। যে সি-ক্লাস মহাকাশযান আমরা ব্যবহার করছি তা একটি বিজ্ঞান গবেষণাগার। কাজেই আপনাদের আতঙ্কিত হবার কিছু নেই।
– আমরা অত্যন্ত আনন্দিত আপনাদের দেখা পেয়ে। মার্কেল হাসিমুখে বললেন। পৃথিবীতে আগমনের হেতু জানতে পারি?
– আপনি মিথ্যা বলছেন মিঃ মার্কেল। আপনারা আনন্দিত হননি, আতংকিত হয়েছেন। আমাদের সূর্যের বয়স আপনাদের থেকে অনেক বেশি এবং আমাদের সভ্যতাও আপনাদের থেকে অনেক বেশিদিন ধরে এই গ্যালাক্সিতে আছে। প্রযুক্তি এবং স্যাটেলাইট ডাটা সংগ্রহে আমরা আপনাদের থেকে অনেক বেশি দক্ষ। আমরা বৃহস্পতির কাছাকাছি ছিলাম। কিছু রসদ সরবরাহ করার জন্য পৃথিবীতে এসেছি। সেটা হয়ে গেলেই আমরা চলে যাব। ভয় পাবার কিছু নেই।
মার্কেল কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। সভায় হাসির রোল উঠল। এত সুন্দর ইংরেজিতে কথোপোকথন হচ্ছে যে তারা প্রথমে চমকে গেলেও এখন পুরো ঘটনা বেশ আনন্দের সাথে উপভোগ করছেন। এরকম ইতিহাসের সাক্ষী কজন হতে পারে?
– আতংকিত হওয়াটা কি স্বাভাবিক নয়? না বলে কয়ে এভাবে কেউ আসে? মার্কেলের কাছে একের পর এক প্রশ্ন আসতে শুরু করেছে সদস্যদের কাছ থেকে।
– আমরা একটা সায়েন্টিফিক অবজার্ভেটরি স্পেসশিপে এসেছি। আপনাদের আতংকিত হবার কিছু নেই। আপনাদের সাথে যোগাযোগ করার দরকারও আমাদের ছিলো না। তবুও আমাদের বিজ্ঞান কাউন্সিলের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা আজকে এখানে এসেছি। আমাদের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন আপনাদের মনে করিয়ে দেয়া দরকার জাতি স্বার্থের উর্ধ্বে উঠেও প্রজাতি হিসেবে মানুষের আরো উত্তরণ হতে পারে।
– সেটা কিভাবে?
– নিজেরা মারামারি বন্ধ করুন। বিজ্ঞান গবেষণায় মনযোগ দিন। সবুজ রঙের প্রানীটি এবার তার হাত নামিয়ে ফেলেছে। চালান করে দিয়েছে আলখেল্লার ভেতরে। এদের কারোই চোখের পাপড়ি নেই।
– আমাদের অনেক ভালো ভালো বিজ্ঞানী রয়েছেন। আমরা ইতিমধ্যে মঙ্গলে মানুষ পাঠিয়েছি। প্রজাতি হিসেবে যে একেবারেই আগাইনি সেটা কিন্তু আপনারা বলতে পারবেন না।
– সেটা বলছি না। শেষবার এদিকে আমরা যখন এসেছিলাম তখন আপনাদের সভ্যতা মাত্র বর্ণ লিখতে শুরু করেছিল। আপনারা খুবই নতুন তবে বুদ্ধিমান মস্তিষ্ক আছে। আমরা আরো বেশি কিছু আশা করেছিলাম।
সভাকক্ষে আবার নিরবতা নেমে এসেছে। সবাই বুঝতে পারছে ঠিক কত আগের কথা বলছে এই প্রানীগুলো।
– আপনাদের কাছে থেকে আমাদের অনেক কিছু জানার আর শেখার আছে।
– সভ্যাতার বিচারে আমাদের প্রাপ্ত জ্ঞান আপনাদের দেয়ার সময় এখনো হয়নি। আমরা একটা গ্যালাকটিক কাউন্সিলের সদস্য। কাউন্সিল ঠিক করে কাদের সাথে জ্ঞান আদান-প্রদান করা যায়। মানুষের এখনো অনেক দূর যেতে হবে। প্রানী হিসেবে আপনারা খুবই নিন্মশ্রেণীর।
সভার সবাই চুপ হয়ে গেল। অপমানিত বোধ করার বদলে তারা এই প্রানীর পরের কথা শোনার জন্য আগ্রহী।
– আমরা শুনছি আপনারা বলুন।
– আপনাদের সকল জ্ঞান আমরা ইতিমধ্যে সংগ্রহ করেছি এবং যাচাই বাছাই করেছি। পৃথিবীর ভাষাগুলো আমাদের ট্রান্সলেটরে যুক্ত করেছি সহজ যোগাযোগ করার জন্য। ইংরেজী বেছে নিয়েছি কারন সবাই কমবেশি আপনারা এই ভাষাটা জানেন। আমরা খুবই মর্মাহত লক্ষ্য করেছি, আপনাদের দুটো দেশ একটা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে যাচ্ছেন। যেটা কোন বুদ্ধিমান প্রানী করবে না।
এই সময় চায়নীজ ডেলিগেট উত্তেজিত হয়ে বলে বসলেন, “আমরা আগেই বলেছিলাম, এইগুলা আমেরিকান বুজরুকি। না পেরে এখন নাটক করছে।
– আহ, আপনি থামুনতো। সার্গেই এবং আর বেশ কজন নাকবোঁচাকে থামিয়ে দিলেন। পৃথিবীর সবাইকে একসাথে বোকা বানাতে পারে না কেউ।
– যা বলছিলাম… প্রানীটি আবার শুরু করল। এবার তার গায়ের রঙ কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে নীলাভ আকার ধারন করেছে। সেই সাথে তার আলখেল্লার রঙ ও পরিবর্তিত হয়েছে। আপনারা এখনো পরমাণু বিভাজনের যুগেই আছেন। এখনো শক্তি অর্জন করতে হয় ভেজিটেশন এর উপর নির্ভর করে বা যে সকল প্রানী ঘাস লতাপাতা খায় তাদের উপর নির্ভর করে। খুবই প্রাচীন এবং বর্বর পদ্ধতি।
– বর্বর কেন হবে? মার্কেল উৎসুকভাবে জানতে চান। খাদ্য গ্রহন কি বর্বর কোন কাজ?
– পদ্ধতিটা বর্বর। আপনাদের পৃথিবীর হিসেবে আমাদের গাছ মানব বলতে পারেন। আমাদের গায়ের রঙ আমরা ইচ্ছেমত বদলে ফেলতে পারি। আমরা সরাসরি যেকোন আলোক উৎস থেকে নিজেদের চলার জন্য শক্তি সংগ্রহ করি। এখানে এসে দেখলাম মানুষ এবং অন্যান্য প্রানীরা এখনও গাছপালা খায়। সে হিসেবে আমাদের গ্রহে আপনারা গাছভূক বলে বিবেচিত হবেন। মানুষ যেমন মানুষ খায় না, আমরাও তেমনি গাছ খাওয়া দেখতে পারিনা।
– ইভোলিউশন পদ্ধতি আমাদের এভাবে তৈরি করেছে।
– সেটা অবিশ্বাস করছি না আমরা, তবে এতদিনেও নিজেদের ইভোলিউশন ঠিক করতে না পারাটা এবং একটা অস্বাস্থ্যকর পদ্ধতিতে শক্তি সংগ্রহ করাটা বুদ্ধিমান প্রানীর পরিচয় নয়।
– শুধু এই কারনেই আপনারা মানুষকে নিন্মশ্রেনীর ধরে নিলেন?
– কারন আরো আছে, সেটা ব্যাখ্যা করতে চাচ্ছি না আমরা। আগেই বলেছি আমরা যুদ্ধ করতে আসিনি, সায়েন্টিফিক মিশনে এসেছিলাম। কিন্তু গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করলাম, আমাদের আসার পর আপনারা আতংকিত হয়েছেন এবং অন্তত দুটো দেশ আমাদের উপর পারমানবিক হামলা চালাবার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন।
– এ তথ্য আপনারা পেলেন কোথায়? মার্কেল সহ অনেক বিস্ময় প্রকাশ করলেন।
– আপনাদের সকল ডেটা সেণ্টারের তথ্য আমরা পড়তে পারছি। খুবই আদিম স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। আমাদের আজকের এই মিটিং এ আসাটাও এই কারনে। পারমানবিক হামলা চালানো হলে আমাদের কোন ক্ষতি হবে না, কিন্তু পৃথিবীর বিপুল অংশের সবুজ গাছপালা নষ্ট হয়ে যেতে পারে, সমুদ্রেরও ক্ষতি হবে। আমরা কোনভাবেই চাইনা আমাদের কারনে মানুষ অন্য প্রজাতির ক্ষতি করুক।
– ওহ… মাই লর্ড…। মার্কেলের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিয়েছে। আপনারা কেউ জানেন আপনাদের কোন দেশ এইরকম হঠকারী সিদ্বান্ত নিয়েছে?
সবাই চুপ, কেউ কথা বলছে না।
– দয়া করে বলবেন কারা এরকম সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
– সেটা আমরা বলতে চাইছি না। শুধু আগাম সতর্কবার্তা আর দুঃখ প্রকাশ করছি মানুষের নির্বুদ্ধিতার জন্য। আমাদের গ্রহে আমাদের ইভোলিউশন হয়েছে গাছ থেকে। আমাদের আদি পুরুষ তারা। পৃথিবীতে এসে আমাদের খুব অস্বস্তি হচ্ছে। আপনারা চলে গেলেও গাছেদের ইভোলিউশন হতে থাকবে। সময়ের বিচারে আপনারা খুব নগন্য এবং জঘন্য।
– আমরা এখন কি করতে পারি? এরকম কিছু যেন না ঘটে সেই চেষ্টা করব আমরা।
– সেটা আপনারা ভালো জানেন। আমরা কোন প্রজাতির বিনাশ চাই না। আমাদের মহাকাশ যানে একটা সিজিয়াম ডুপ্লিকেটর আছে। চাইলেই সেটা দিয়ে আপনাদের জল আর বাতাস বিষাক্ত করে দিতে পারি। গাছপালা আবার সবুজ হয়ে যাবে একসময় … শুধু আপনারা থাকবেন না। কিন্তু আমরা সেটা করব না।
– এটা কি হুমকির মত হয়ে গেলো না?
– আমরা হুমকি দিতে আসিনি। একটা বিজ্ঞান গবেষনাগার চালিয়ে এসেছি। আপনাদের সাবধান করছি। জানিয়ে যাচ্ছি যে আপনারা খুবই আদিম জীবন যাপন করছেন। বদলাবার সময় এখনও পার হয়ে যায় নি।
– শুনে খুব ভালো লাগল।
– তবে জেনে রাখুন গ্যালাকটিক এম্পায়ারের সবাই আমাদের বিজ্ঞানীদের মত চিন্তাশীল নয়। তারা কেউ কেউ আপনাদের বিরুদ্ধে একশন নিতে চাইলে আমাদের কিছু করার থাকবে না। কিছুক্ষন পরেই আমরা নিজেদের গ্রহের দিকে রওয়ানা হয়ে যাবো। সেখানে কাউন্সিল ডিসিশন নেবে কি করা যায়। আমরা শুধুই একদল বিজ্ঞানী, আমরা যোদ্ধা নই।
– এই সিদ্ধান্তে আসতে আপনাদের কতদিন সময় লাগতে পারে? মানে আমরা নিজেদের প্রস্তুত রাখতে চাই আপনাদের পরবর্তী আগমনের জন্য।
– পৃথিবীর সময় আর আমাদের সময় একভাবে চলে না। তবে নিজেরা হিসাব করতে চাইলে শ’দুয়েক বছর ধরে রাখতে পারেন। এর মাঝে নিজেদের পরিবর্তন করতে না পারলে অন্য প্রজাতির স্বার্থে কাউন্সিল যে সিদ্ধান্ত নেবে সেটাই মেনে নিতে হবে আপনাদের।
– ওহ… মাই লর্ড। আমার নাতিপুতিও থাকবে না সে সময়। মারকেল বেশ চিন্তিত ভাবে বললেন। তবে বেশ লম্বা সময়। হয়ত এর মাঝে মারামারি করে আমরা নিজেরাই শেষ হয়ে যাবো! কষ্ট করে আপনাদের আর কোন সিদ্ধান্ত নিতে হবে না।
সভায় আসা সদস্যরা সবাই মোটামুটি বুঝতে পারছেন মানুষ হিসেবে তাদের দৈন্যতা কতটা ভয়াবহ। ভবিষ্যতের জন্য কি করা যায় তা পরে তারা সিদ্ধান্ত নেবেন। এখনই কোন আক্রমন হচ্ছে না সেটাই আশার বিষয়।
– আমরা আশাবাদী, এর মাঝে আপনারা নিজেদের শুধরে নিতে পারবেন। শুধু জেনে রাখুন, কোন ভাবেই কাউন্সিলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জিততে পারবেন না। আপনাদের ওই পারমানবিক অস্ত্রগুলো আমাদের কাছে খেলনার মত।
– আমরা আসলে যুদ্ধের চিন্তাও করছি না। আমি শুধু ভাবছি এই পৃথিবীটা আমাদের নিজেদের গ্রহ, এখানেও আমরা আর নিরাপদ নই।
– কে বলেছে এটা আপনাদের? মানুষের আগেও আরো অনেক প্রজাতি এসেছিল। সবাই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। হোমো সেপিয়েন্সরা কসমিক স্কেলে নিতান্তই শিশু। ভাল থাকুন। আমরা এখন বিদায় নিচ্ছি।
– কিন্তু আমাদের আরো অনেক প্রশ্ন ছিলো! অনেক কিছু জানার ছিলো আপনাদের কাছ থেকে।
– সময় হলেই জানতে পারবেন, তার আগে নয়। আগে শান্তিতে সহাবস্থান করতে শিখুন। যুদ্ধ করা বাদে আপনাদের অন্যান্য প্রযুক্তির উন্নতি ঘটুক।
সভা কক্ষ থেকে ধীরে ধীরে তারা বিদায় নিলেন। বাইরে হয়ত তাদের নিজস্ব কোন বাহন রাখা ছিল। সবাই উৎসুক নজরে দরজার দিকে অনেক্ষন চেয়ে রইল। মার্কেল গলা উঁচিয়ে সবার নজর নিজের দিকে ফেরালেন।
– সম্মানিত সদস্যগণ, ওনারা নিজেরাই আমাদের সাথে যোগাযোগ করে এসেছিলেন। আমরা কোনভাবেই তাদের সাথে গত চারদিনে যোগাযোগ করতে পারিনি। এখনে সবার উপস্তিতিতেই তারা কথা বলতে চেয়েছিলেন। সবাই নিজের চোখেই দেখলেন এবং শুনলেন। আমাদের করনীয় কি বলে মনে করেন?
সভাকক্ষের সবাই আবার গুঞ্জন তুলে ফিসফাস করা শুরু করে দিয়েছেন। কারো মাথায় কিছু আসছে না। শুধু জাপানিজ প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবো বললেন, “‘আমি ভেজিটেরিয়ান নই।” তার মুখে মৃদু হাসি দেখা যাচ্ছে।
0 Comments