জানুয়ারী মাসটা কেটেছে মহা যন্ত্রনার মধ্যে দিয়ে। নয়ডার যে ভাঙ্গাচোরা বাসায় উঠেছিলাম সেটার অস্বাভাবিক ভাড়া নিয়ে প্রথম থেকেই আমার অসন্তোষ ছিল। আমার স্ত্রীও ছাদে গিয়ে অন্য এক ভাড়াটিয়ার সাথে কথা বলে জেনেছে আমাদের কাছ থেকে তিনগুন বেশি ভাড়া নেয়া হচ্ছে! রেনু নামের এই ভদ্রমহিলা দরকারে আমাদের অন্যজায়গায় বাসা ভাড়া করে দিতে চাইলেন।
এরা অনেকটা ফাঁদে ফেলে আমাকে এই বাসায় এনে তুলেছে। আমি একা ভ্রমন করতে সবসময় পছন্দ করি। কারন তাতে নিজের মত করে থাকা এবং খাওয়া যায়। অথবা এমন কারো সাথে যারা ভ্রমনের সময় নিজের ব্যবস্থা নিজেই করে নিতে পারে।
দেশেও দেখেছি, যতবারই পরিবার নিয়ে কোথাও কেউ ভ্রমন করতে যায়, সব কিছুতেই গলাকাটা দাম দিতে হয় তাদের। অনেক কিছুই তখন সহ্য করে যেতে হয় বাচ্চা আর মহিলাদের মুখ চেয়ে।
ওবায়েদের কথায় এখানে নাফিস আমাদের এই বাসা খুঁজে দিয়েছিল। মাস শেষ হবার সাথে সাথেই সে ভাড়া নিতে আসে অগ্রীম। আমি মৃদু অসন্তোষ জানিয়ে তাকে দুদিন পরে আসতে বলি। কারন এই বাসায় থাকার চেয়ে হোটেলে থাকা আমার কাছে হাজার গুনে ভালো মনে হয়েছিল। অন্তত দিনরাত পানি, বিদ্যুৎ আর নিরাপত্তা আছে সেখানে।
কিন্তু আমার সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, সাথে যারা আছে তাদের রান্নার ব্যবস্থা আছে এমন হোটেল দরকার। ভাগ্যের কি পরিহাস, নতুন বাসায় মাস শেষ হবার সাথে সাথেই ফ্ল্যাটের মালিক এসে হাজির। আমাদের কাছে যে বাসা ভাড়া দেয়া হয়েছে, সেটা তিনি জানেন না। আর ভাড়ার অংক শুনে তার চোখ কপালে উঠল। তিনি আমাকে আশ্বস্ত করে বললেন, “আপনি থাকুন, আমি দেখছি ব্যাপ্যারটা। এই নাফিসকে আর কোন ভাড়া দেবেন না।’ ভদ্রলোকের নাম দিপেন্দার সিং। তিনি বেজায় চটেছেন নাফিসের এই এহেন কর্মে।
এক কথায় দুকথায়, ব্যপ্যারটা সোসাইটি পর্যন্ত গড়ালো। দিপেন্দর দাদা জানতে চাইলেন আমার নামে কোনও ডিড বা চুক্তিনামা হয়েছে নাকি? আমি বলে দিলাম, না! নাফিস নিজের নামেই সেটা করেছে আর আমাকে বলেছে এখানে মুসলামানদের বাসা ভাড়া দেয়া হয় না। দিপেন্দর আরো ক্ষেপে গেলেন এই কথায়। বললেন এরা সবার নাম খারাপ করছে। এরকম কিছুই হচ্ছে না এখানে। কিন্তু একজন ফরেনারের থাকতে গেলে কিছু নিয়ম মেনে পুলিশ ভেরিফিকেশন করতে হয়। আমি সায় দিলাম যে ব্যাপারট আমিও জানি। নাফিস এর কিছুই করেনি। মাঝখান থেকে ফেঁসে গেলাম আমি।
এ ব্যাপ্যারটা প্রথম থেকেই আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিল নাফিস এবং ওবায়েদ। ভারত জুড়ে মুসলমানদের বিশাল সমস্যা চলছে। সব কিছুতেই একটা অচলবস্থা… ইত্যাদি।
অথচ ফ্ল্যাটের মালিক এবং আশেপাশের মানুষজনের সাথে কথা বলে বেশ অমায়িক মনে হয়েছে। তারা আমাদের সাথে কোন ধরনের বাজে ব্যবহার করেননি। প্রয়োজনে খোঁজখবর নিয়েছেন, বলেছেন যেকোন দরকারে তাদের জানাতে আর নাফিসের কাছ থেকে তারা পরের মাসের ভাড়াও আদায় করেছেন।
হোটেল রামপাল প্যালেস…
আরো ৪-৫ দিন আমি আনন্দাশ্রয় সোসাইটিতে রয়ে গেলাম। এরপর আবার ফিরে এলাম জাসোলাতে। কারন এই রামপাল হোটেলেই রান্না করার মত জায়গা রয়েছে। বেশিরভাগ বাংলাদেশী রোগীরা এখানেই এসে ওঠে।
ভাগ্যের কি পরিহাস, যে জাসোলাকে আমি নিরানন্দ আর পানসে ভেবেছিলাম। সেখানে ফিরে এসে এবার কিছুটা ভালো লাগছে।
একটা ব্যাপার পরিষ্কার, রাজনৈতিক অস্থিরতা বাদ দিলে, ভারতীয় শিক্ষিত সমাজ কোনভাবেই চায়না তাদের দেশের নাম বাইরের কারো কাছে খারাপ হোক। আমি যত মানুষের সাথেই কথা বলেছি সবাই বেশ আনন্দের সাথে আমার কথা শুনেছেন। ধর্মের বাইরে গিয়েও যে মানবতা আছে সে ব্যাপ্যারে বলেছেন। তারাও যে বর্তমানে ভারতের অবস্থা নিয়ে বিরক্ত সেটা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছি আমি।
এই যে মিডিয়া এবং ভারতজুড়ে আইনের মারপ্যাচে মসজিদের জায়গা দখল, আর মারামারির রমরমা ব্যবসা, এটা শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করার জন্যই উসকে দেয়া হচ্ছে।
নয়ডার ঠান্ডা আমার ঠিক সহ্য হচ্ছিলো না। রাতের বেলা মাঝে মধ্যে ৬-৭ ডিগ্রিতেও নেমে যেতো। জাসোলাতে এসে কিছুটা ভালো লাগছে। এখানকার তাপমাত্রা ১২-১৮ ডিগ্রি।
0 Comments