বর্জন বনাম অর্জন

Jun 15, 2024দেশ ভাবনা0 comments

দেশে একটা বিপ্লব চলছে, অন্তত সোশ্যাল মিডিয়ায় আমজনতার হুংকারে তাই মনে হচ্ছে। ফিলিস্তিনের জনগনের উপর জাতিগত নিধন প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে এদেশের জনগন একটা অক্ষম বিপ্লব চালানোর চেষ্টা করছে। তারা কোকাকোলা বর্জন করার ডাক দিয়েছে। সেই সাথে আরো দু’য়েকটা পানীয় যেগুলো এই একই কোম্পানীর ব্যানারে উৎপাদিত হয়।

অনেক আগের স্বদেশী আন্দোলনের মত, বিকল্প হিসেবে তারা দেশী ব্রান্ড মোজো বা প্রান কোলার দিকে ঝুঁকছেন। আপাত দৃষ্টিতে দেখতে খুব রোমান্টিক মনে হলেও, এটা আসলে একটা কর্পোরেট লড়াই। কোকাকোলা দেশের কোমল পানীয় বাজারের সবচেয়ে বড় অংশ দখল করে রেখেছে। বাকিরা উৎপাদনেও পিছিয়ে, স্বাদেও পিছিয়ে। স্বাভাবিক ভাবেই ক্রেতার কাছে কোকাকোলা বা সেভেন আপই প্রথম পছন্দ। এই বর্জনে তাদের কিছুটা অর্জন হচ্ছে।

কোকাকোলার জন্ম আমেরিকায়। ১৮৮৬ সালে ডা. জন এস পিম্বারটন অ্যাটলান্টা জর্জিয়ায় প্রথম এই সিরাপ তৈরি করেন। তিনি একজন ফার্মাসিস্ট ছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল ব্যাথানাশক হিসেবে এই সিরাপের ব্যবহার করা। সেই থেকে শুরু, এরপর লম্বা সময়ের ব্যবধানে এই কোকাকোলা বিভিন্ন রুপে বিশ্বের ২০০টিরও বেশি দেশে বিক্রি হচ্ছে। তাদের সাপ্লাই চেইনের ব্যাপ্তি পৃথিবীজুড়ে।

সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ কোকাকোলা বর্জন চলছে দেশে। একদিক থেকে ভালোই। এই বস্তু খাদ্য তালিকায় না থাকলে মানবজাতির কোন অপকার হবে না। যেমনটা চা-কফি বাদেও চলে, তাও আমরা খাই।

খুব অদ্ভুত বিষয় হলো বৃহৎ জনগোষ্ঠী কোমল পানীয় বর্জনের কথা বলে না। সকল ধরনের কোমল পানীয় স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। সেটা যেখানেই উৎপাদিত হোক।

কোক বদলে কেনো মোজো খেতে হবে? ওতে ভিটামিন আছে? শরীরের উপকার হবে? যুদ্ধটা হবার দরকার ছিলো ভাল আর খারাপের মাঝে। কিন্তু, হয়ে গেছে কর্পোরেট বনাম কর্পোরেটের।

ক্যাপিটালিজমের পৃথিবীতে সবাই ব্যবসায়িক লাভের কথা চিন্তা করে। এদেশে লেবু খেতে গেলেও সেটার হালি ১০০ টাকা হয়ে দাঁড়ায়। মননে আর অভ্যাসে গোবর রেখে বিপ্লব হয় না।

সাধারন জীবন যাপনের সবথেকে বড় মন্ত্র হলো, যেটা আপনার দরকার নেই সেটা কিনবেন না, পকেটে টাকা থাকলেও না। বাহুল্য বর্জন করুন, পৃথিবী বদলে না গেলেও, আপনি বদলে যাবেন।

এই বর্জন থেকে যদি আপনি যদি কোমল পানীয় নির্ভরতা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে পারেন তবে সেটাই আপনার ব্যক্তিগত অর্জন। আর যদি কোমল পানীয়ের বদলে আরেকটা কোমল পানীয় বেছে নেন সেটা হবে নির্বুদ্ধিতা।

ইন্টারনেটে প্রাপ্ত তথ্যমতে কোকাকোলার সবথেকে বড় শেয়ারের মালিক Berkshire Hathaway, যেটার সিইও হচ্ছেন ওয়ারেন বাফেট। পাবলিক শেয়ার বেচার কারনে আরো হাজার হাজার সাধারন বিনিয়োগকারীও এর মালিক। এককভাবে বর্তমানে কেউ আর কোকাকোলার মালিক নন। ক্যাপিটালিজম এট ইটস বেস্ট।

এমন একটা পৃথিবীতে আমরা বসবাস করি যেখানে মানুষের প্রানের থেকে অর্থের মূল্য বেশি। যার যত বেশি টাকা, বেঁচে থাকার সম্ভাবনাও তার তত বেশি।

নচেৎ কত আগেই পৃথিবী থেকে ক্ষুধা আর ক্যান্সার নির্মূল হয়ে যেতো। সেই সাথে যুদ্ধও বন্ধ হয়ে যেত। ইসরায়েল আর ফিলিস্তিনের মধ্যে চলা সমস্যা কোন ধর্মযুদ্ধ নয়, এটা জাতিগত হত্যা। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।

কোক বর্জনের ডাক মানুষের আবেগ থেকে এসেছে, যুক্তি থেকে নয়। তবুও ভাল এতে পরিবেশ এবং মানব স্বাস্থ্যের উপকার হবে। অহেতুক চিনি যত কম খাবেন ততই মঙ্গল।

যদি সকল ধরনের ক্যাপিটালিস্ট পন্য বর্জনের ডাক দেয়া হয়, তবে ফেইসবুক, টুইটার, ইউটিউব ইত্যাদিও বর্জন করতে হবে। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। কাজেই গোড়ায় গলদ রয়েই যাচ্ছে। এভাবে বিপ্লব হবে না। যারা ইজরায়েলকে সমর্থন করছে, তারা এককভাবে কোকের টাকার উপরে নির্ভরশীল নয় বা মোটেই নয়।

সবচেয়ে দূর্ভাগ্যের বিষয় হলো বেশিরভাগ মানুষ ফিলিস্তিন নিয়ে চিন্তিতও না। তারা নিজের খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে পারলেই খুশি। দেশে মানুষ প্রতিদিন একবেলা অবশ্যই কোক খায় না। এটা বর্জনে তাই বিশাল কোন অর্জন নেই।

অনেক কিছুই বর্জন করা দরকার, ঘুষ, দূর্নীতি, হত্যা, বাতিল রাজনীতিবিদ, কালোবাজারী ইত্যাদি। সেই হিসেবে বর্জনের খাতা আমাদের শূন্য, অর্জনের খাতাও শূন্য।

বিচিত্র ব্যাপার হলো, এই সকল লাফালাফি সোশ্যাল মিডিয়া কেন্দ্রিক, সেটার উৎপত্তিস্থল হচ্ছে ফেইসবুক।

0 Comments

মন্তব্য

দেলোয়ার জাহান

মনের একান্তে কিছু কথা থাকে যা কাউকে বলা যায় না। বলতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খায় আমাকে। সে সকল হাবিজাবি জীবন দর্শন আর কিছু অসময়ের কাব্য নিয়ে আমার লেখালেখির ভুবন।

Pin It on Pinterest

Share This