আলিনা অধ্যায় ২৭: আয়নায় দেখা মুখ

Jul 8, 2025আত্মকথন0 comments

আলিনা আমাকে বলল, “বাবা জানো আমার একটা বন্ধু জিজ্ঞেস করেছে তুমি সবসময় একই ড্রেস পরে থাক কেন?”

আমি হাসলাম। এই প্রশ্নটা খুব স্বাভাবিক। আলিনাকে স্কুলে আনতে নিতে গেলে আমি খুব সাদামাটা পোশাক পরে যাই। আমার জিন্স সবসময় না হলেও বেশিরভাগ সময়েই নীল রঙের হয় আর আমার টিশার্ট গুলো ঘুরে ফিরে একই রকম। যদি আমি শার্ট পরি তবে সেগুলোও এক রঙের হয়। আমি খুব ডিজাইন করা কিছু পরতে চাই না। বয়সের তুলনায় আমি খুব সাদামাটা ভাবে চলতে চেষ্টা করি।

কোথায় জানি একবার পড়েছিলাম – Simple living, High Thinking. এটা আমার মাথায় গেঁথে গেছে। পোষাকের রং আর চক্রাবক্রা ডিজাইনের পেছনে আমি মূল্যবান সময় নষ্ট করতে চাই না। আমি শুধু চেষ্টা করি পরিচ্ছন্ন পোষাক পরতে। আমার এমন অনেক শার্ট আছে যা আমি বছরের পর বছর ধরে পরছি। আমার ভাল লাগে। যেহেতু চাকরি বাকরি কিছু করি না, তাই আমাকে ধোপদুরস্ত হয়ে থাকতে হয় না।

আমি আলিনাকে সবসময় উপদেশ দেই যদি জুতা কেনো, বা ব্যাগ কেনো তবে সবার আগে দেখতে হবে সেটা আরামদায়ক কিনা। স্টাইলের থেকে আরামদায়ক হওয়াটা জরুরী। হাইহিল জুতা বা স্যান্ডেলের থেকে কেডস অনেক বেশি আরামদায়ক। চেষ্টা করবে কেডস পরতে। কে কি ভাববে সেটার দিকে মনোযোগ দেবে না। রোদে গেলে সানগ্লাস ব্যবহার করবে… ইত্যাদি।

আলিনার অর্ধ-বার্ষিক পরীক্ষা চলছে। একেকটা পরীক্ষা দিয়ে আসে আর আমি জিজ্ঞেস করি কেমন হল? আলিনা নিরানন্দ গলায় বলে “মোটামুটি”। সে কখনো ভালো হয়েছে এটা বলতে চায় না।

– মোটামুটি মানে কি?
– মানে খারাপ আর ভালোর মাঝখানে। আলিনা নির্লিপ্ত গলায় বলে।

বাংলা তার কাছে খুব কঠিন পরীক্ষা। গণিত বা ইংরেজী নয়। বাংলা পরীক্ষার আগে বন্ধ দেয়নি এই কারনে তার মন খারাপ। ইংরেজী পরীক্ষায় সে কিছু গ্রামার ভুল করে এসেছে এটা নিয়ে তাকে একটু চিন্তিত মনে হল। তবে আমি চিন্তিত নই। আলিনা যথেষ্ট ভালো ইংরেজী জানে, এখন দরকার অভ্যাসের। আমি নিজেও ক্লাস ফোরে থাকতে গ্রামার পারতাম না। এখনও ভুল হয়ে যায়। অথচ ইংরেজীতে আমি সারাজীবন লেটার মার্ক পেয়ে এসেছি।

আমি বাকি অভিভাবকদের মত পরীক্ষা শেষে তার কাছ থেকে প্রশ্নপত্র কেড়ে নিয়ে ভুলের হিসাব মেলাতে বসি না। এই সকল পরীক্ষার জন্য জীবনের কোথাও আটকাবে না।

রাস্তায় দেখা হলে কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করেনা- ভাই আপনার ক্লাসে রোল নম্বর কত ছিল? আমিও কাউকে এমন কিছু জিজ্ঞেস করি না।

অর্থ উপার্জনের অনেক পদ্ধতি আছে দুনিয়াতে। ক্লাসের সবথেকে লাড্ডুগুড্ডু ছেলেটাও একসময় বড় ব্যবসায়ী হয়। আমাদের অভিভাবকেরা ভালো মানুষ বা জ্ঞানী হবার জন্য বাচ্চাদের স্কুলে পাঠায় না। তারা বিশ্বাস করে পড়াশোনা করে একসময় সে অনেক অর্থ উপার্জন করতে পারবে। অর্থ উপার্জনকেই তারা সফলতার মাপকাঠি ধরে। সমাজে জ্ঞানের থেকে অর্থের সম্মান আর প্রতিপত্তি বেশি।

এজন্যই আমাদের কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষক, কবি, সাহিত্যিক এর বদলে রাজনীতিবিদ আর নীতিহীন গাধা তৈরি করে। এরা মুখস্থ বিদ্যায় পন্ডিত হয় কিন্তু উদ্ভাবনে আর সততায় শূন্য।

আমরা কর্পোরেট দাস তৈরির কারখানা বানিয়েছি। তাদের সার্টিফিকেট দেই। কে কত বড় গাধা হয়ে বের হয় সেটা সার্টিফিকেটে লেখা থাকে। গুটিকয়েক উন্নত মাথা তারা দেশে থাকে না। এরা কোনরকমে কারখানার গন্ডি পার হতে পারলেই, দেশের বাইরে চলে যায়। সেখানে গিয়ে তার প্রতিভার স্বাক্ষর রাখে। আমাদের গত ৫০ বছরের অর্জন হচ্ছে, আমরা উন্নত চিকিৎসার জন্য, উন্নত শিক্ষার জন্য, উন্নত খাবারের জন্য, উন্নত ঔষধের জন্য, ভাল পরিবেশে ঘোরার জন্য দেশের বাইরে চলে যাই।

আমেরিকা, ইংল্যান্ড বা ইউরোপের ভিসা পেলে তাই আমাদের গর্বিত নাগরিকেরা স্বর্গসুখ লাভ করে।


0 Comments

মন্তব্য

দেলোয়ার জাহান

মনের একান্তে কিছু কথা থাকে যা কাউকে বলা যায় না। বলতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খায় আমাকে। সে সকল হাবিজাবি জীবন দর্শন আর কিছু অসময়ের কাব্য নিয়ে আমার লেখালেখির ভুবন।

Pin It on Pinterest

Share This