আলিনার স্কুলে গল্প লিখতে দিয়েছে। যেকোন বিষয় নিয়ে গল্প লিখে নিয়ে যেতে হবে। এটা মনে হয় দেয়ালিকার জন্য। স্বভাবতই তার মা আমাকে এই দায়িত্ব দিলো তাকে একটা গল্প লেখায় সাহায্য করার জন্য।
আমি গল্প লিখি কিন্তু তার বেশিরভাগই সায়েন্স ফিকশন বা জটিল মানব মনস্তত্ব নিয়ে। বাচ্চাদের গল্প কখনো লিখিনি। আলিনাকে জিগ্যেস করলাম কি নিয়ে গল্প লিখতে হবে? সে একটু ভেবে বলল একটা বেড়াল আর পাখি নিয়ে লিখে দাও। আমি বেড়ালের নাম আর পাখির নাম জানতে চাইলাম তার কাছে।
– বেড়ালের নাম দাও মিনু।
– কেন? বেড়ালের নাম দেই “মিউ”!
– না, বেড়ালের নাম হবে মিনু।
– আর পাখির নাম?
– পাখির নাম হবে টিনা।
– পাখির নাম “পিউ দেই”?
– না পাখির নাম টিনা দিতে হবে।
ওকে… এই অদ্ভুত নামেই একটা গল্প লেখা হল। কিন্তু গল্প লেখা শেষে আলিনা জিগ্যেস করল, এই গল্পের মোর্যাল কি?
– মোরাল নেই। এটা এম্নিতেই একটা হাবিজাবি গল্প।
– মোর্যাল নেই কেন?
– সব কিছুর মোর্যাল থাকে না। শুধু মজা করার জন্যও আমরা অনেক কিছু লিখি, এটা সেরকমই জিনিস।
যেহেতু রেডিমেড গল্প পাওয়া গেছে তাই আলিনা আর কিছু জানতে চাইল না।
*****
একদিন স্বপ্ন সুপার শপে যাচ্ছি বাজার করতে। সাথে আলিনাকে নিয়েছি, সে আইসক্রিম কিনবে। হেঁটে যেতে যেতে তার সাথে আলাপ করি আমি-
– দেখেছো রাস্তায় কত কুকুর? ওরা মনে হয় খেতে পায় না, ওদেরকে কেউ খাবারও দেয় না।
– ওরা ময়লা খায়। আলিনা বলল।
– বলো কি?
– ময়লা খেয়ে ওরা অসুস্থ হয়ে যায়। তারপর মনে করে আবার ময়লা খেলে সুস্থ হয়ে যাবে, তাই আবারও ময়লা খায়।
– ওরা তাহলে ময়লা খেতেই থাকে?
– হুম…। আলিনা হেসে দিলো।
স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা চলছে। আলিনা যে পড়াশোনায় খুব বেশি মনোযোগী তাও নয়। আমি নিজেও তার উপর পড়ার জন্য খুব বেশি চাপ দেয়ার পক্ষপাতি নই। শৈশব খুব দ্রুত চলে যায়। যেটুকু সময় পারুক নিজের মত করে আনন্দ করুক। তাই পরীক্ষায় খারাপ করলেও আমার তরফ থেকে কোন বকাবকি নেই। আমি প্রচন্ডভাবে ঘৃণা করি মেধার তুলনা করতে। সব বাচ্চাই বড় হয়ে একই রকম জীবন প্রণালীর মাঝে যাবে না। সবার খুব বেশি মেধাবী হবারও দরকার নেই। হলে ভালো, না হলেও জগতের কিছু যায় আসবে না। দরকার সভ্যতা শেখা, যুক্তি শেখা।
আমাদের পড়াশোনা এবং পরীক্ষা পদ্ধতিতে বিশাল ভূল আছে। যাক সে আলোচনা অন্যদিন করব।
বাংলা পরীক্ষা শেষে সে আমাকে একটা মৌলিক প্রশ্ন করেছে। বাবা কবিতা পড়ে কি হবে? এই যে আমরা মুখস্থ করেছি কবিতা এতে কি লাভ হবে? আমি নিশ্চিত এই প্রশ্ন হুট করে তার মাথায় আসেনি। সহপাঠী বা অন্যকারো কাছ থেকে শুনে সে আমাকে এই প্রশ্ন করেছে।
কবিতা পড়ে কি হবে যে বাচ্চা এই প্রশ্ন করতে পারে, সে ইতিমধ্যে যথেষ্ট বুদ্ধিমান। STEM এর বিষয়গুলো বাদে আর বাদবাকি বিষয়ের কোন দরকার নেই এরকম একটা ধারনা আমাদের অভিভাবকদের মধ্যে থাকতে পারে। তবে জীবনে কবিতারও দরকার আছে। পৃথিবীবিখ্যাত লেখকেরা, বিজ্ঞানীরা একাডেমিয়ানরা কবিতা পছন্দ করেন। কেন করেন?
আলিনাকে আমি স্কুল মাঠে হুট করে জবাব দিতে পারিনি। শুধু বলেছি, কবিতা পড়লে তোমার শব্দ ভান্ডার মানে ভোকাবুলারি বাড়বে। জানি এটা ঠিক উত্তর হয়নি। তবে ওই মূহুর্তে আমার মাথায় গভীর কোন উত্তর আসেনি।
কবিতা বা ছড়া বাচ্চাদের পড়ানো হয় কেন? বড়রাই বা কবিতা পড়ে কেন? কবিরা কবিতা লেখে কেন?
বাচ্চাদের নিশ্চয়ই কবি হবার জন্য কবিতা পড়ানো হয় না! লেখক বা কবি হবার কোন স্কুল নেই। তবে আমরা কবিতা লিখি বা পড়ি কেন?
বাচ্চাদের স্কুলে কবিতা পড়ানো হয় বেশ কয়েকটি কারনে। প্রথমটি হল, তার কল্পনাশক্তি বাড়ানোর জন্য। বাচ্চাদের কবিতাগুলোকে আমরা ছড়া বা ছন্দ কবিতাও বলতে পারি। এগুলো জীবনের গভীর বোধের থেকে মজার এবং শিক্ষামূলকই বেশি হয়ে থাকে। একটু বড় ক্লাসে নৈতিকতা নিয়ে লেখা কবিতাগুলো থাকে।
দ্বিতীয়ত, কবিতা ভাষা ব্যবহারে দক্ষতা এবং শব্দভান্ডার সমৃদ্ধ করতে শেখানো হয়।
তৃতীয়ত, কবিতা মনে রাখার ক্ষমতা তাকে বাকি পড়াশোনা মনে রাখতেও সাহায্য করে। এটা অনেকটা দৌড় শেখার মত। জীবনের নানা কাজে কখন কিভাবে ব্যবহার হচ্ছে আপনি বুঝতেই পারছেন না। কিন্তু অবচেতনে প্রতিদিন ব্যবহার করে যাচ্ছেন।
মূল কথা হচ্ছে, কবিতার কোন খারাপ দিক নেই।
সাহিত্য তারাই ভালবাসে যারা উন্নত চিত্তের অধিকারী হয়। সেই সাহিত্যের একটা মজার অংশের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য বাচ্চাদের কবিতা পড়ানো হয়।
বড়দের কবিতা নানা রকম ভাগে বিভাজন করা যায়। কবিতা আমি নিজেও পড়ি, কারন ভালো লাগে। যে কথাটা বলতে একশ পৃষ্ঠার একটা বই লাগবে। মাত্র দশ লাইনে কিভাবে সেটা বলে ফেলা যায়, এটা খুব আশ্চর্যের একটা ব্যাপার।
গভীর জীবনবোধ আর কষ্টের কথা তো থাকেই, সেই সাথে থাকে প্রতিবাদ। কবিতা প্রতিবাদের একটা মাধ্যম। বড়দের কবিতায় তাই প্রেম আসে, ভাঙ্গন আসে, ধর্ম আর রাজনীতি আসে। কবিতা লেখার জন্য তাই মাঝে মধ্যে জেলেও যেতে হয় অনেক কবিকে।
আধুনিক কবিদের কবিতা পড়লে আশিভাগ লোকই বলবে না এগুলো কবিতা। কারন স্কুলে তারা ছন্দে ছন্দে যে কবিতা পড়ে এসেছেন এগুলো তার থেকে আলাদা। এর লাইনে লাইনে ছড়ানো অবদমিত আবেগও তারা বুঝতে নারাজ। স্কুলের পরপরই তাদের মানসিক উন্মেষ বন্ধ হয়ে গেছে। পরীক্ষা পাশের জন্য যে পড়া সেটা পড়েই তারা ক্লান্ত। কবির ক্লান্তি তাদের ছুঁয়ে যাবে না আর কোনদিন।
কেউ কেউ এক হাজার কবিতা লিখেও কবি হয়ে উঠতে পারেন না, আবার কারো একটা লাইনই তাকে হাজার বছরের জন্য কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে দেবে।
কবিতা হচ্ছে ভাষা ব্যবহারে একজন মানুষের সর্বোচ্চ দক্ষতার পরিচয়। এমন কোন লেখক পাওয়া যাবে না, যিনি একটা হলেও কবিতা লেখেননি। জীবনের কোন না কোন সময়ে তিনি এই জাদু দেখাবার চেষ্টা করেছেন।
0 Comments