আলিনা অধ্যায় ২৩: খাদ্য শৃঙ্খল

Sep 11, 2024আত্মকথন0 comments

আলিনার স্কুলে নতুন ক্যান্টিন খোলা হবে। স্কুল ছুটির পর আনন্দের সাথে আমাকে জানিয়েছে সে। বলেছে ক্যাণ্টিন খুললে সে আর বাসা থেকে টিফিন আনবে না, শুধু টাকা নিয়ে আসবে।
– আজকে টাকা নিয়ে আসোনি?
– এনেছি তো, আজকে একটা চিকেন ফ্রাই খেয়েছি। ৫০ টাকা দিয়ে বার্গারও আছে। আরো অনেক কিছু বিক্রি করে, আমি দেখেছি।
– ৫০ টাকার বার্গার খুব বেশি ভালো হবার কথা না।
– সবাই খায়তো, আর আমার ফ্রেন্ড আমাকে একটা ঝালমুড়ি দিয়েছে খেতে।

যেদিন তার মুড ভাল থাকে সেদিন রাজ্যের গল্প হয় আমার সাথে, ক্লাসে কে কোন গ্রুপ করেছে। কে ফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়া করেছে আর মিস কাকে বকা দিয়েছে। তার নিজের জগতের গল্প। আমি খুব কমই অনুপ্রবেশ করি সেই জগতে। মাঝে মধ্যে শুধু টুকটাক হুঁ-হা করি।

স্কুলের বাইরে টিফিনের সময় নানা ধরনের দোকান বসে। গেইটের ফাঁক দিয়ে হাত বাড়িয়ে সেগুলো কেনা যায়। আবার ছোট একটা ঘরের মত করে জানালা করে দেয়া হয়েছে সেখান থেকেও ছাত্রীরা খাবার কিনতে পারে। পুরো ব্যাপারটাই আলিনার কাছে রোমাঞ্চকর। নিজের টাকা দিয়ে নিজ হাতে জিনিস কেনার অন্যরকম একটা মজা আছে। অন্যসময় যা কিছু লাগে বাবা-মাকে বলতে হয়। কিন্তু নিজে কিনতে পারাটায় একটা স্বাধীনতা আছে।

বাসায় যে মেয়ে নিজে নিজে খেতে চায় না, স্কুলে গেলে সে বন্ধুদের সাথে নিজে কিনে খাবার খাচ্ছে, এটাই আমার কাছে আনন্দের। বাসায় তাকে খাবার বানিয়ে দিলে আমি এরকম সাজিয়ে দেই।

আলিনা অধ্যায় ২৩: খাদ্য শৃঙ্খল 1
ভাতকে ফ্রাইড রাইস বানানোটা একটা শিল্প

আলিনা আমাকে বলে, বাবা তুমি খুব “ফ্যান্সি” করে রান্না করো। আমি হাসি। খাবার আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ন একটা বিষয়, আমি খাদ্য রসিক। কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই আমাকে কাজের চাপে না খেয়ে থাকতে হয়। ছোট থাকতে রেস্টুরেন্টের খাবার আমার খুব একটা খেয়ে দেখা হয়নি। দামি জুতা বা জামা কাপড় কেনা হয়নি। আমি পোষাকের ব্যাপারে খুব উদাসীন আছি এখনও। তবে জুতো আর খাবার এই দুটো জিনিস আমি এখন নিজের পছন্দ মত কিনি। দামী নয় তবে সেরাটা ব্যবহার করার চেষ্টা করি। আমার কাছে স্টাইলের থেকে আরামদায়ক হওয়াটা বেশি জরুরি।

আর খাবারের বিষয় হচ্ছে “ঘ্রানং অর্ধনং ভোজনং” এর মত, খাবার দেখতেও সুন্দর হতে হবে। ফুটপাত থেকে ফাইভস্টার কোথাও খেতে আমার আপত্তি নেই।

একটা দেশের মানুষের খাদ্যাভাস নির্ভর করে তাদের জীবানাচরন আর সংস্কৃতির উপর। আর যেসকল পুরুষেরা মনে করে খাবার রান্না করা শুধুমাত্র মেয়েদের কাজ, তাদের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। আমি যত সেরা খাবার খেয়েছি সবই পুরুষ বাবুর্চির রান্না করা।

কয়েকদিন আগে একটা জার্নালে পড়লাম, ভারতীয়দের ভুড়ি হবার কারন তারা বেশি পরিমানে ভাত এবং সবজি জাতীয় খাবার খায়। এগুলোর ফার্মেণ্টেশন হয় পেটে গিয়ে। সেকারনেই এই অঞ্চলের লোকজনের ভুড়ি ইউরোপিয়ানদের তুলনায় বড় হয়। এটা অবশ্য একটা সাধারণ হিসেব। এখন অনেক স্বাস্থ্য সচেতন ব্যাক্তিই সাদা চালের ভাত এড়িয়ে চলেন। খাবারে কার্বের বদলে, আমিষকে প্রাধান্য দেন।

আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি আপনি চিনি খাবেন না, লবণ কম খাবেন আর ভাত খেলেও সেটা পরিমিত খাবেন। জাপানিজরাও ভাত খায়, চাইনিজরাও ফ্রাইড রাইস খায় প্রচুর। কিন্তু, কটা ভুড়িওয়ালা জাপানিজ দেখেছেন আপনি? সমস্যাটা বোধহয় অন্যকোথাও।

আমাদের এখানে মাংস দামী একটা খাবার ছিল সেই আদিকাল থেকেই। এখনো প্রচুর চাল উৎপন্ন হয়, আর সবজি মোটামুটি সারাবছরই পাওয়া যায়। আমাদের খাদ্যাভাসে এরা তাই প্রধান খাবার হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। মুসলিম শাসকেরা আসার পর থেকে হয়ত মাংস খাবার প্রচলন বেড়েছে।

হাল আমলে ফার্মের মুরগি বাড়ায় আমিষের একটা বড় অংশ এটা দিয়ে পূরণ হচ্ছে। বাচ্চারা বাদে অন্যদের দুধ খাবার দরকার না থাকলেও বুড়োরাও দুধ খায় প্রচুর পরিমানে। যেটা আসলে স্বাস্থ্যের উপকারের থেকে অপকারই বেশি করে। ডিম খেতেও আমাদের মানুষ খুব হিসেব নিকেশ করে। একটা বদ্ধমূল ভূল ধারনা আছে প্রবীনদের মধ্যে যে, ডিম খেলে প্রেশার বাড়ে।

চা – জিনিসটা আমি খুব একটা খাই না। আমার পছন্দ কফি, তাও কদাচিৎ। কিন্তু বাঙ্গালীরা ছেলে থেকে বুড়ো সবাই চা পানে খুব বেশি অভ্যস্ত। এমন কোন জায়গা নেই যেখানে টংয়ের দোকানে চা বিক্রি হয় না। আর সেটাতেও প্রচুর পরিমানে চিনি আর দুধ দিয়ে বানানো হয়। আমাদের দিন শুরু হয় অস্বাস্থ্যকর ভাবে। চায়ের নেশা অবশ্য বৃটিশ আমল থেকে এদেশীদের মগজে ঢুকেছে। আর আফিম এসেছিল চায়না থেকে। আফিম বাংলাদেশে বিলুপ্ত হয়ে গেলেও চা রয়ে গেছে।

জাপানীজদের গড় আয়ু পৃথিবীর মানুষের তুলনায় অনেক। এটা মুলত তাদের খাদ্যাভ্যাস আর জীবনচারন থেকে হয়েছে। মোদ্দা কথা আপনি কি খান সেটা ঠিক করে দেয় আপনি কতদিন বাঁচবেন, আপনার রোগ-শোক কেমন হবে।

আমরা অনেক কিছুই আমদানি করেছি বাইরের দেশ থেকে। ফাস্টফুড, তেলেভাজা আলু আর মুরগী এখন শিল্পের পর্যায়ে। এগুলো এদেশে আসার পর থেকেই আমাদের লোকজনের মাঝে, উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট এটাক, স্ট্রোক এই রোগগুলো বেড়ে গেছে। বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো দেখবেন রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেদারসে গিলছে এসব পশ্চিমা খাবার। এদের দেহ স্থুলাকার আর চলাফেরা খুব ধীর।

আমি নিজেও মাঝে মধ্যে খাই, কিন্তু অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারিনি। বিশেষ করে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই নামক আলুভাজা জিনিসটা আমার চরম অপছন্দের। বাচ্চাদেরকে এই বস্তু না দেয়াটাই উত্তম।

খাবার নিয়ে অনেক গালগপ্প দিয়ে ফেললাম। এখন একটা দরকারি কথা বলি। প্রতিটা স্কুলেই একটা ক্যান্টিন থাকা দরকার। যেখানে বাচ্চাদের ব্রেকফাস্ট সার্ভ করা হবে। সকালে বাচ্চারা অনেকেই না খেয়ে আসে। আর খাবার তৈরির প্রক্রিয়ায় তাদেরকে সংযুক্ত করা উচিৎ। পরিচ্ছনতা এবং রান্না দুটোই শিখে যাবে তারা। সেই সাথে বোনাস হচ্ছে আত্মতৃপ্তি আর ধৈর্যের পরীক্ষা। এমন না যে সারামাসই তারা এরকম করবে। মাসের একটা দিন একঘন্টার জন্য খাবার তৈরির কাজে তাদের সাহায্য নিলে পড়াশোনার পাশাপাশি তারা জীবনের পাঠটাও বুঝে নিতে পারবে।

0 Comments

মন্তব্য

দেলোয়ার জাহান

মনের একান্তে কিছু কথা থাকে যা কাউকে বলা যায় না। বলতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খায় আমাকে। সে সকল হাবিজাবি জীবন দর্শন আর কিছু অসময়ের কাব্য নিয়ে আমার লেখালেখির ভুবন।

Pin It on Pinterest

Share This