আলিনাকে রোবলক্স থেকে একদিনের জন্য ব্যান করেছে। ঘটনা খুবি সাধারন। সে কোন একটা গেইম খেলার সময় চ্যাটিং এ কারো কারো সাথে ঝগড়া করেছে। কিছু শব্দ সে নিশ্চই এমন ব্যবহার করেছে যেটা কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড ভংগ করেছে। মজার বিষয় হচ্ছে এরা আবার সেই সব শব্দের একটা লিস্টিও দিয়েছে। তার মধ্যে একটা শব্দ হচ্ছে “Noob” – এটা আমি নিজেও গেইম খেলার সময় হরহামেশা ব্যবহার করি।
আমি জানি সে এই শব্দগুলো শিখেছে অনলাইনে গেইম চ্যাটিং এর সময়েই, অথবা ইউটিউব থেকে। কাঁদো কাঁদো স্বরে এসে আমাকে যখন বলছে, বাবা আমি এগুলো কিছুই বলিনি, আমার খুব হাসি পেলো।
শুধু বললাম, তুমি নিশ্চই বলেছো, জেনে বা না জেনে।
– আমি বলিনি বাবা। কেউ নিশ্চই আমার একাউন্ট হ্যাক করে আমাকে দিয়ে বলিয়েছে।
– না রে মা। এটা তুমিই করেছো তোমার একাউন্ট হ্যাক হয়নি।
যদিও আলিনা নির্দোষ এটা সে বারবার প্রমান করার চেষ্টা করছে, কিন্তু আমি কথায় কান দিলাম না।
– তুমি বিশ্বাস করো বাবা আমি এগুলো বলিনি।
– ঠিক আছে আমি বিশ্বাস করলাম, তুমি এরকম ভাবে বলতে চাওনি। কিন্তু বলে ফেলেছো। এখন অপেক্ষা করো, একদিন পরে ঠিক হলে তারপর আবার খেলতে পারবে।
আলিনা মন খারাপ করল। সে আমাকে অবশ্য জোর করছিল তাকে আরেকটা একাউন্ট খুলে দিয়ে গেইম খেলতে দেয়ার জন্য। আমি মানা করে দিলাম। বললাম, প্রত্যেকটা কাজের ফলাফল পেতে হয়। যা করেছ সে জন্য তোমাকে একদিনের জন্য বহিষ্কার থাকতেই হবে।
আমি শেখানোর চেষ্টা করি আমার অভিজ্ঞতা আর ব্যাক্তিগত নৈতিকতা থেকে। বাকিটা নিয়তির হাতে। কর্মের ফল ভোগ করতে হবে। “সিস্টেম বাইপাস” করার চেষ্টা করলে নৈতিকতা গড়ে ওঠে না।
একদিন আলিনাকে আমি বাইক সম্পর্কে শেখালাম। গ্যারেজে বাইক রাখার সময় অনেকটা আমার বাইকের মত আরেকটা বাইক দেখে সে বলেছিল, দেখো বাবা তোমার মত সেইম। আমি বললাম, এটা একই ইয়ামাহা কোম্পানির বাইক। কিন্তু দেখতে একই রকম হলেও এটা আলাদা।
– কেনো? একটা কোম্পানি কি একটাই বাইক বানায় না?
– না একই কোম্পানির নানা মডেলের বাইক থাকে। একই মডেলের আবার অনেক ভার্সন থাকে। যেমন তোমার ক্লাস থ্রি-তে অনেকগুলো সেকশন আছে, সেরকম।
– তাহলে ওরা জানে কি করে, কোনটা ভালো? কেনার পর যদি দেখে একটা পচা বাইক?
– বাজারে অনেকগুলো কোম্পনির অনেক ধরনের বাইক আছে। কেনার আগে তারা রিভিউ দেখে আর পরিচিত মানুষজনকে জিগ্যেস করে।
– হুমম…।
– আরেকটা জিনিস জেনে রাখো, সব বাইককেই হোন্ডা বলে না। হোন্ডা একটা কোম্পানির নাম, বাইকের নাম না।
এই অবাঞ্ছিত তথ্য তার কোন কাজে লাগবে কিনা জানিনা, তবে জ্ঞান দিতে ভাল লাগে বলে দিয়ে দিলাম। মানব মস্তিষ্ক অনেক রহস্যময়, স্মৃতির পাতা থেকে কখন কোন জিনিস টান দিয়ে তুলে নিয়ে আসে জানা দুষ্কর।
জুলাইটা খুব দুঃসহ হয়ে দেখা দিলো। স্কুলের পরীক্ষা শেষ হতে পারল না। তার আগেই দেশজুড়ে ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়ে গেলো। সবকিছু বন্ধ করে দিয়ে শেষ রক্ষার চেষ্টা করলেন মাননীয়া, তাও পারলেন না। অনেকটা – “দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি, সত্য বলে, আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি” – এর মত অবস্থা।
একটার পর একটা লাশ পড়তে লাগল। পরিস্থিতি হয়ে গেলো ভয়ানক।
কার্ফুর মধ্যে একদিন আলিনাকে নিয়ে হাসপাতালে গেলাম মায়ের জন্য। রিকশায় চড়ার জন্য অতি মনরোম সময়। আমি নানা কথা বলে আলিনাকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছি। কারন হাসপাতাল তার কোনকালেই পছন্দ না। সে প্রথম থেকেই অনীহা প্রকাশ করছে।
– তুমি জানো দেশে কি হচ্ছে?
– কি?
– সবাই মারামারি করছে।
– কেন মারামারি করছে? আলিনার প্রশ্ন।
– কারন মারমারিতে যে জিতবে তার দাবি মেনে নেয়া হবে?
– কি দাবি?
– দাবি অনেক, ন্যায্যতার ভিত্তিতে মূল্যায়ন চায় তারা। … দাবি মনে হচ্ছে চাওয়া, অনেকটা তোমার আইসক্রিম চাওয়ার মত।
– ও…।
– মারামারি দেখতে যাবে?
– কেন?
– এমনিতেই। দেখবে মানুষ মানুষকে মেরে কিভাবে মানুষের সমাজ প্রতিষ্ঠা করে।
আলিনা আমার জটিল কথার কিছুই বুঝল না। তবে তার মুখে বালিকা সুলভ হাসি। আমি শুধু বললাম, আজকের জন্য তোমার সব দাবি মেনে নেয়া হল। আমার সাথে হাসপাতালে গেলে যা খেতে চাইবে তাই খাওয়াবো। দাদু তোমাকে দেখলে খুশি হবে।
মনে মনে ভাবছি, কিছু মানুষ অকারনেই আমাকে যেমন ভালোবাসে, তোমাকেও দাদু সেরকম ভালোবাসে। কে জানে কখন কার সাথে আমাদের শেষ দেখা হয়ে যায়। জগতে অপরিসীম ঘৃনার বিপরীতে একমাত্র ভালোবাসাটাই সত্যি। আজকে প্রধানমন্ত্রী যদি ভালোবেসে কিছু কথা বলতেন, হয়ত দেশ এত বড় বিপর্যয়ের মুখোমুখি হত না। তিনি তার ভূল স্বীকার না করে, অহংকার আকঁড়ে ধরে বসে থাকলেন। ঝরে গেল নিরীহ ছাত্র, জনতা আর পুলিশের লাশ। জীবন আর সম্পদের কি নিদারুণ অপচয়।
জুলাই রক্তাক্ত হয়ে গেলো বাংলাদেশের ইতিহাসে। যে ‘সিস্টেম কলাপসের’ আশা আমরা করে বসেছিলাম তা এরকম রক্তাক্ত হবে কল্পনা করতে পারিনি।
ভাল থাকুক তারার সন্তানেরা, এই নক্ষত্রের নিচে।
প্রতিজ্ঞা মত আমি তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম শেফস টেবিলে। পেছনের দেয়ালের আলপনা আলিনার খুব পছন্দ হয়েছিল। অন্যসময় সে আমার সাথে ছবি তুলতে না চাইলেও আজকে একবার বলাতেই রাজি হয়ে গেছে।
পুনশ্চঃ
এই বন্ধে আলিনা বাসায় বসে কিছু ছবি এঁকেছে। আমি ছবির শিল্প সমঝদার নই, ভালো মন্দ বুঝি না। কন্যা যাই আঁকুক আমাকে ভালো বলতেই হবে। শুধু একটাই সমস্যা স্কুলের পরীক্ষার সময় ছবি আকঁতে নাকি তার ভাল লাগে না। ড্রইং টিচারটা নাকি খুব বদরাগী।
0 Comments