কয়দিন থেকে একটা গান খুব বেশি মাথার ভেতরে বাজছে, কোক স্টুডিও বাংলা, সিজন ২ এর “বনবিবি”। এর আগে আরেকটা গান শুনেছিলাম অর্ণবের সন্ধ্যাতারা। সেটাও পরপর কয়েকবার শুনেছিলাম অর্ণবের জাদুকরি গলার জন্য।
আর এখন বনবিবি গানটা যতবার শুনি ততবারই ভালো লাগে। তপুর গলায় কেমন যেন একটা সময়ের পেছনে ফিরে যাবার হাহাকার বাজে।
বেঁচে থাকলে আরো দশ বছর পরে এই গানটা আমি শুনে দেখতে চাই, তখনও এরকম জাদুকরী লাগে নাকি গানটা সেটা যাচাই করা দরকার। বুড়ো হয়ে গেলে রুচির পরিবর্তন কিভাবে হয় সেটা জানা দরকার!
আমাদের শিশুরাও বদলায়, খুব দ্রুত বদলায়। যে বাবা একসময় সব কিছু জানতো, সেটাই পরিণত হয়, “বাবা কিছু বোঝে না” তে।
আরেকটা বছর কেটে গেছে আলিনার স্কুলে। বার্ষিক পরীক্ষা প্রায় আসি আসি। আশেপাশের পরিবেশ থেকে শিক্ষাগ্রহণ পদ্ধতিও পরিবর্তিত হয়েছে মেয়েটার। সে হয়ত জানেই না, আমি কত সুক্ষভাবে তার পরিবর্তন লক্ষ্য করি। ওদের পৃথিবীটা খুব দ্রুত ঘোরে।
তার বন্ধুত্বের সংজ্ঞাটা গাঢ় হয়েছে। ক্লাসে তার দু’জন প্রিয় বান্ধবী আছে। তাদের কথা বলার সময় তার চোখমুখে যে আনন্দ ফুটে ওঠে সেটা দেখার মত! তাদের জন্য মাঝে মধ্যেই এটা সেটা নির্দোষ উপহার নিয়ে যেতে হয় তাকে।
আচ্ছা মানুষ যাকে পছন্দ করে তাকে উপহার দিয়ে খুশি করতে চায় কেনো?
উপহারের সংস্কৃতি সুপ্রাচীন এবং প্রজাতি ভেদে ভিন্ন। কিন্তু সৃষ্টিজগতের সবাই এই ব্যপারটা কিভাবে যেন আয়ত্ত্ব করে ফেলে। মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে অন্যান্য প্রজাতি থেকে উন্নত বলে সে খাবার বাদেও নানারকম জিনিস উপহার হিসেবে ব্যবহার করে।
একটা সাধারন তত্ত্ব আমি জানি, সেটা হচ্ছে, সঙ্গী বা সঙ্গিনীকে উপহার দেয়া মানে প্রকৃতিতে নিজের প্রজনন এর সম্ভাবনা বাড়ানো। ফুল নিজের রঙ উজাড় করে দেয়, সুবাস ছড়ায়, প্রকৃতিতে রঙের মেলা বসায়, পাখি সুরেলা কণ্ঠে ডাকে, ময়ুর পেখম মেলে নাচে শুধু এই কারনেই। আপনার আমার মনোরঞ্জনের জন্য নয়। আবার সেই ফুল মানুষ ব্যবহার করে প্রিয় মানুষের মন পাবার জন্য।
সেটাই আবার কাউকে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য, বা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমরা ভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করি। ভালোবাসার থেকে আনুষ্ঠানিকতা সেখানে মুখ্য থাকে।
সবাইকেই প্রতিযোগিতা করতে হয় এই পৃথিবীতে।
স্কুল থেকে ফেরার সময়, রাস্তায় অনেক কাদা। আমি দুষ্টামি করে মাঝে মাঝেই বলি – “এইবার যদি বাইক নিয়ে আমরা পড়ে যাই, ধপাস করে… তবে?”
“তখন কি হবে?” আলিনা জানতে চায়।
– আমাদের পা ভেঙ্গে যাবে?
– ভেঙ্গে গেলে কি হবে?
– একটা নকল পা লাগাতে হবে।
– আর হাত ভেঙ্গে গেলে? আলিনা মজা পায়।
– আরেকটা হাত লাগাতে হবে! আমি নিরাস গলায় বলি।
– যদি মাথা ভেঙ্গে যায়?
– মাথা ভেঙ্গে গেলে, আমরা মরে যাবো।
“কেনো… নতুন মাথা লাগানো যাবে না?” আলিনা হাসি হাসি মুখে বলে। আমি জবাব দেয়ার আগে একটু চিন্তা করি।
– শোনো, এখনো পর্যন্ত আমাদের দেখা মহাবিশ্বের সবথেকে জটিল জিনিস হচ্ছে মানুষের এই মস্তিষ্ক। আমাদের সাধ্যই হয়নি এটাকে পুরোপুরি বোঝার। হয়ত ভবিষ্যতে মানুষ এটাকে বুঝতে পারবে। তখন পারলেও পারতে পারে মাথার বদলে আবার মাথা লাগিয়ে নিতে।
– তুমি কঠিন করে বলো, আমি বুঝি না।
সহজ করে কিভাবে বলতে হবে আমি আসলে জানি না। কিছু জিনিস সহজ করে আপনি চাইলেও বলতে পারবেন না। সব প্রজাতিরই পরিবর্তন হচ্ছে এবং হবে। প্রথমদিকে সেটা দীর্ঘ সময় ধরে প্রাকৃতিকভাবে হোত, এখন মানুষ এই ইভোলিউশন নিজের হাতে তুলে নিয়েছে।
পৃথিবী মাতার অবশ্য তাতে কিছু যায় আসে না। নিত্যনতুন ঝামেলা পাকিয়ে তিনি সাম্যবস্থা বজায় রাখার চেষ্টা করছেন। বিলিয়ন বছর আগে যে রাসায়নিক পরিবর্তন শুরু হয়েছিল মিলিয়ন মিলিয়ন কিলোমিটার দূরের সূর্যে, তার ফসল আমরা। আমরাই প্রথম প্রান নই এবং আমাদের পরেও পৃথিবী থেমে থাকবে না।
খুবই আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে আমাদের এই মস্তিষ্ক, যা ভাবতে পারে নিজের উৎপত্তি আর গন্তব্য নিয়ে। এর থেকে জটিল কি হতে পারে? আমরা হচ্ছি মহাবিশ্বের সেই অংশ যা নিজেকে নিয়ে ভাবতে শিখেছে। তাইতো মানুষ খাবার আর প্রজনন নিশ্চিত হবার পরেও শিল্প, সাহিত্য আর মহাকাশ নিয়ে ভাবে! আমি নিজের চিন্তা থেকে ফেরত আসি আবার বাস্তবে।
– আরো একশ বছর যেতে দাও, মানুষ মাথা, পা, কিডনি, হার্ট, ফুসফুস সব বানাতে শিখে যাবে।
– তখন কি হবে?
– কি আর হবে… মানুষ আজীবন বেঁচে থাকার দুঃখেই মারা যাবে।
আলিনা কিছু বলে না। এত জটিল দার্শনিক কথা বোঝার সময় তার নাই। আশেপাশে এত মজার জিনিস, সেখানে বাবার বোরিং টাইপের কথাবার্তায় সবসময় তাল মেলানো যায়না।
সময় খুব অদ্ভুত জিনিস, কত দ্রুত রঙ মাখিয়ে চলে যায়। পৃথিবীটা একদিন বদলে যাবে, এই তুচ্ছ প্রজাতির বদলে অন্যকোন আরো বুদ্ধিমান প্রজাতি আসবে! নতুন মহাবিশ্ব আসবে, সেখানে আমাদের কেউ মনে রাখবে না। এনট্রপি বাড়ছে, সেই সাথে বাড়ছে বিশৃঙ্খলা।
মহাবিশ্ব গানিতিক বিশৃংখলায় চলছে, আমাদের নজরে আমরা সেটাকে খুবই নিয়মতান্ত্রিক দেখতে পাই। প্রজাতি হিসেবে পৃথিবীতে আমরা এত উঁচু স্তরের হয়েও নিজেদের নিজেরাই খুন করি জাতি, ধর্ম আর কাল্পনিক সীমারেখা টেনে।
মাঝে মাঝে তাই ভাবি, হয়ত এই বিশৃংখলাই প্রকৃতি চেয়েছিল। সে চেয়েছিল এমন একটা বুদ্ধিমান প্রান তৈরি করতে যারা সবচেয়ে বেশি শক্তির অপচয় করতে পারবে। বিক্রিয়ার সাম্যাবস্থা নিয়ে আসাটা জরুরী, তাতে শক্তি সবজায়গায় সমানভাবে বন্টন করা হবে। ভবিষ্যতের মহাবিশ্ব হবে অন্ধকার আর শান্ত।
0 Comments