আলিনা অধ্যায় ১৮: মেঘ বলেছে যাব…যাব

Jun 18, 2023আত্মকথন0 comments

।। এক ।।

বৃষ্টি আমার আর আলিনা দুজনেরই পছন্দের। বাবার অনেক জিনিস তার অপছন্দ হলেও কিভাবে যেন আমার এই একটা রোগ তার মাঝখানেও একটু ছড়িয়ে গেছে।

প্রচণ্ড গরমে যখন অস্থির আমাদের জীবন, একটু বৃষ্টির দেখা পেলেই, আকাশটা একটু গোমড়া হলেই আমি তাই আলিনাকে জিজ্ঞেস করি বাইরে যাবে?

সে মাথা নাড়িয়ে জানায় যাবে।

– কিন্তু তিরিশ মিনিট পরে, আমি একটু গেইম খেলে নিই।
– ঠিক আছে, কিন্তু মনে রেখো তিরিশ মিনিট পরে কিন্তু রেডি হতে হবে।

আমরা অযথাই ঘোরাঘুরি করি। বেশিরভাগ সময়েই ঘোরাঘুরির জন্য একটা বাহানা বানাতে হয়। কারন তার মাকে যখনই বলি আমরা বাইরে যাচ্ছি, সে জানতে চায় “কেন? এই গরমে বের হবার দরকার কি?”

আলিনা অধ্যায় ১৮: মেঘ বলেছে যাব...যাব 1

—-

আলিনার কিছু জমানো টাকা আছে, ঈদে উপহার পাওয়া। সে যখনই কিছু আবদার করে আমি বলি, তোমার টাকা থেকে খরচ করবে। সে রাজি হয়। আমি তাকে জিনিসটা কিনে দেই এই শর্তে যে বাসায় গিয়ে আমাকে জমানো টাকা থেকে দাম দিয়ে দেবে। বাসায় এসে সে ভুলে যায়, আর আমিও মনে করিয়ে দেই না।

এবার ইউনিমার্টে গিয়ে তার একটা পানির বোতল আর স্লাইম পছন্দ হয়েছে। আমি দাম দেখে বললাম, এটার সাথে ভ্যাট আছে। এরা অনেক বেশি দাম রাখে। ভ্যাটও বেশি দিতে হবে।

– ভ্যাট কি?
– এটা সরকারকে দিতে হয়?
– ঠিক আছে আমি তোমাকে এটার দাম দিয়ে দেব, কিন্তু ভ্যাট দেবো না।
– কেন, ভ্যাটতো আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবে।
– ঠিক আছে তুমি হিসেব কর ক্যালকুলেটরে মোট কত টাকা হয়।

আমি হিসেব করে বললাম, ‘পাঁচশ টাকার কিছু বেশি আসবে ভ্যাট সহ’।

– না হবে না, আমি ভ্যাট দেবো না।
– ভ্যাট তো আমি নেই না, সরকার নেয়।
– আমি তোমাকে শুধু ঐ টাকাই দেব।

ভ্যাটের কিছু না বুঝেও আমার কন্যা কোনভাবেই মূল দামের বাইরে আমাকে ভ্যাট দিতে রাজি হলো না। কি বিচিত্র!

—-

এখন অবশ্য আলিনার অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা চলছে। যদিও সেটাকে ঠিক পরীক্ষা মনে হচ্ছে না। একটা উৎসব উৎসব ভাব চলছে সব বাচ্চাদের মাঝে। অভিভাবকদের উৎকণ্ঠা তাদের মাঝেও ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে, কিন্তু তারা বুঝতে পারছে না পরীক্ষাতে উদ্বিগ্ন হবার মত কি আছে?

এদের হাসিহাসি মুখগুলো দেখতে আনন্দ লাগে। অভিভাবকদের উৎকণ্ঠা তাদের খুব একটা ছুঁয়ে দেয় না।

সেদিন একজন অভিভাবক আমার সামনে বলছিলেন, এখানে বাচ্চাদের পড়ার প্রেশার কম। সামনের বছর তিনি বাচ্চাকে ইংলিশ মিডিয়ামে দেয়ার চেষ্টা করবেন। সেখানে পড়ার প্রেশার আছে…।

আমি কিছুটা মনঃকষ্ট নিয়ে তার কথা শুনলাম। বয়স তিরিশ পার হয়ে যাবার পর আপনাকে শিক্ষা নিয়ে নতুনভাবে শেখানো যায় না। আমি যখন স্কুলে ছিলাম তখন দ্বিতীয় শ্রেনীর বাচ্চাকে বাংলা-ইংরেজীর প্রথম আর দ্বিতীয় পত্রের ঝামেলা সামলাতে হয়নি। এখন শুরু থেকেই সেটা করা হচ্ছে। অনেক স্কুলে আবার বোর্ড নির্ধারিত বইয়ের বাইরেও একটা দুইটা বই কিনে পড়ানো হচ্ছে। ……আরো কত প্রেশার চান?

এর মাঝে একদিন একটা ঘটনা ঘটে গেলো। আমার পরিচিত একজন অভিভাবক জানালেন, তার মেয়ের ক্লাস টিচার তার কাছে কোচিং না করার কারনে পরীক্ষার খাতায় নম্বর কম দিয়েছেন।

ঘটনা শেষ পর্যন্ত অনেক দূর গড়িয়েছে এবং প্রিন্সিপাল তদন্ত করে দেখেছেন অভিযোগের সত্যতা আছে। কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে জানি না, তবে এটা নিশ্চিত জানি এই শিক্ষকের শিক্ষা দেবার যোগ্যতা নেই। যোগ্যতা না থাকলেও যেহেতু তার খেয়ে পরে বাঁচতে হবে তাই তার চাকুরি যাবে না। অনৈতিক এরকম হাজারো শিক্ষক দিয়ে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ভরা।

।। দুই ।।

এবারের আরেকটা সংবাদ আমাকে বিস্মিত করেছে। দক্ষিন এশিয়ায় শিক্ষাখাতে বাংলাদেশের বিনিয়োগ সবথেকে কম।

কি দূর্দান্ত… মারহাবা। এমনিতেই একটা টিকটিক প্রজন্ম গজিয়েছে দেশে, যাদের কোন কাজ কর্ম নেই, ভিডিওতে নেচে নেচে দেশ উদ্ধার করে। এদের সমিতি আর সেলিব্রেটি টাইপের লোকজনও আছে।

হুজুগে বাঙালি আছে, ফেইসবুককে আদালত আর এবাদতখানা মানা লোকজন আছে, ওয়াজ মাহফিল আছে, হাসপাতালকে দোকান বানানো হয়েছে, পত্রিকায় পরীমনি আর হিরো আলমের মত তারকার সংবাদ আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের রাজনীতি আছে – কি চলছে এই দেশে?

সেখানেই আবার শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ সব থেকে কম। আপনার যদি মনে হয় আপনি একটা জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করে দেবেন তবে তাদের নতুন প্রজন্মকে শিক্ষিত হবার সেরা সব সুযোগ দিন। সেটা না করে উল্টো পথে হাঁটছে কেন সরকারি নীতি?

কেন জানি মনে হয় আমাদের আমলাতন্ত্র কখনোই চায়না দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ভাল থাকুক। তাতে ভেড়ার পাল বানানো সোজা হবে। আর যাদের টাকার জোর থাকবে তারা এমনিতেই দেশের বাইরে চলে যাবে, বা দেশেই বাচ্চাকে মাসে লাখটাকা খরচ করে পড়াবে।

আর বিশাল একটা জনগোষ্ঠীকে কুঃসস্কার আর কুশিক্ষার মধ্যে রেখে জাতি হিসেবে এত গর্বিত হবার কি আছে? আমি বাজি ধরে বলতে পারি, আপনি শুধু শিক্ষাখাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দিন, এই নতুন প্রজন্মই একদিন সব বদলে দেখাবে।

দেশপ্রেম অনেক ভালো আর মহান একটা ব্যপ্যার। সেটা শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার না করে, কার্যত দেখান। জনগনকে শিক্ষিত হতে দিন, শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করুন। এরাই দেশ বদলে দেবে।

বৃটিশ লেখক স্যামুয়েল জনসন এর একটা উক্তি আছে, “Patriotism is the last refuge for a scoundrel” মানে হচ্ছে- “শয়তানের শেষ আশ্রয়স্থল হলো দেশপ্রেম।”

।। তিন ।।

মোবাইল আসক্তি” শব্দটা খুব পরিচিত লাগে না? যখন কেউ বলে আমার বাচ্চা মোবাইলে আসক্ত, তখন নিশ্চিতভাবে ধরে নেন, বাসার অভিভাবকেরাও সেই নেশায় আসক্ত। একটা বাচ্চা জন্মালেই মোবাইল হাতের কাছে পায় না, তাকে কেউ একজন সেটা দেয়। সেটার ব্যবহার নিয়ন্ত্রন করতে হয়। না করলে প্রথম দোষ অভিভাবকের ঘাড়েই চাপবে।

আপনি বাচ্চার সামনে মোবাইল ব্যবহার করতে থাকবেন, আর তাকে সেটা ব্যবহার করতে না করলে সে শুনবে কেন?

ইদানিং আলিনা মোবাইলে একটু বেশি সময় দিচ্ছে দেখার পর আমি সময় বুঝে তার কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে যাই। স্বেচ্ছায় দিতে চায়না, একটু জোর করতে হয়। কিন্তু তাতেও সই, শাসন করার সময়ে মায়া দেখালে চলে না।

একটু পরেই কিন্তু সে আমার উপর রাগ করে তার পেপার ক্রাফটিং নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তার মানে মোবাইল বাদেও তার বেশিক্ষন মন খারাপ থাকে না।

আলিনা অধ্যায় ১৮: মেঘ বলেছে যাব...যাব 2
আলিনার ক্রাফটিং টেবিল। যদিও এটার মূল কাজ ছিল পড়াশোনা করা, কিন্তু সেটা এখন ডাইনিং টেবিল আর বিছানাতে হয়।

কোনদিন আবার মোবাইলে বিদেশী আইস্ক্রিম দেখে তার সেটা খাবার শখ জাগে। কাঠি আইসক্রিম খেয়ে বড় হওয়া এই আমি তখন খুঁজে বেড়াই কোথায় এটা পাওয়া যায়।

আলিনা অধ্যায় ১৮: মেঘ বলেছে যাব...যাব 3
বিঃদ্রঃ এই আইসক্রীম দেখতে খুব ভালো না হলেও স্বাদ মন্দ না। এটাকে Mochi আইসক্রিম বলে। জাপানে এর উতপত্তি হলেও এদেশের কিছু দোকানেও পাওয়া যায় অনেক চড়া দামে।

আমি বিশ্বের এমন অনেক কিছুই জানি না, যা আলিনা জানে শুধুমাত্র মোবাইলের কল্যানে। তাই হুট করে মোবাইলের পুরোটাই খারাপ বলে দিতে পারি না। এই বয়সের একটা বাচ্চা নিজে থেকে অনেক খাবারে রেসিপি বলে দিতে পারে, নিজে নিজে ওভেন বেক করতে পারে, এটাই অনেক পাওয়া।

বাচ্চারা সবসময় সবাইকে ভালো দেখতে চায়; সবকিছুর ভালোটাই খুঁজে নিতে চায়। আমাদের দূর্বলতাতেই আমরা তাকে আমাদের মত অমানুষ করে গড়ে তুলি।

আলিনা অধ্যায় ১৮: মেঘ বলেছে যাব...যাব 4
দুজন অপরিচিত মানুষের বন্ধু হতে ৩০ সেকেন্ডের বেশি সময় লাগেনি।

|| চার ||

আলিনা অধ্যায় ১৮: মেঘ বলেছে যাব...যাব 5

আজ বাবা দিবস ছিল। কন্যার মা আমাকে সাবধান করে দিয়েছে আমি নিজে থেকে যেন তাকে কিছু জিজ্ঞেস না করি! কারন সে আমার জন্য সারপ্রাইজ গিফট বানাচ্ছে! এটা হচ্ছে তার নমুনা!

সে বড় হতে হতে এই কাগজ আর আমি নাও থাকতে পারি। তাই ডিজিটালি সেইভ করে রাখা। আহা প্রযুক্তি… মানুষের স্মৃতিতেও হানা দিয়ে বসে আছে।

শুধু তার এই হাতে বানানো কার্ডই ছিলও না, সেই সাথে কিছু চকলেট, কয়েকটা রঙ্গিন জেমস ক্লিপ, একটা লাল বেলুন, বিস্কিটের সাথে পাওয়া গাড়ি আর একটা ছোট ডাইনোসরও ছিল।

শুভ বাবা দিবস… তোমাকে অনেক শুভেচ্ছা, কারন “বাবা” বলে তুমি কাউকে ডাকতে পারছ।

0 Comments

মন্তব্য

দেলোয়ার জাহান

মনের একান্তে কিছু কথা থাকে যা কাউকে বলা যায় না। বলতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খায় আমাকে। সে সকল হাবিজাবি জীবন দর্শন আর কিছু অসময়ের কাব্য নিয়ে আমার লেখালেখির ভুবন।

Pin It on Pinterest

Share This