|| এক ||
আমার এমাজন এলেক্সাতে, জেমসের গাওয়া সেই বিখ্যাত “প্রিয় আকাশী” গানটা বাজছে। আর আজকে খুব বেশি করে মনে পড়ছে আমার ফেলে আসা সেই সোনালী শৈশব, অবহেলার, ধুলো-মাটির আর নিজেকে প্রতিদিন লুকিয়ে রাখার কৈশোর।
প্রিয় আকাশী,
গতকাল ঠিক দুপুরে তোমার চিঠি পেয়েছি
ঠিকানা লেখনি,
ঠিকানা পেলে কোথায় তা লেখনি
ঠিকানা পেলে কোথায় লেখনি
আকাশী ও আকাশী
সুদীর্ঘ প্রবাসের অর্ধেকটা কাটিয়েছি
বোহেমিয়ানদের মত ঘুরে ঘুরে
মাদ্রিদ থেকে হামবুর্গ; নিউক্যাসল্ নেপোলি থেকে প্রাগ বুখারেষ্ট মেসিডোনিয়া;
আকাশী ও আকাশী
আমার আকাশী…
নোট: গানটির কথা লতিফুল ইসলাম শিবলীর, মূল কবিতা ‘প্যারিসের চিঠি’ থেকে সংক্ষেপিত ভাবে নেয়া হয়েছিল।
আমার কৈশোর রাঙ্গিয়ে দিয়ে যাওয়া আর বোহেমিয়ান শব্দের অর্থ খুঁজে বেড়ানোতে জেমসের এই গানের বিরাট ভূমিকা আছে। আজকে আবার শুনতে শুনতে হারিয়ে যাচ্ছিলাম সেই সময়টায়। তখন স্কুলে যাবার সময় গাছের পাতা ঝরা দেখতাম আর ফাগুনের সেই হাওয়া অদ্ভুত একটা শূন্যতা তৈরি করত আমার মনে। কাউকে বলতেও পারতাম না আবার এই ভালোলাগা আর খারাপ লাগায় মেশানো পরিবেশটা কারো সাথে ভাগাভাগিও করতে পারতাম না।
আলিনা নতুন ক্লাসে উঠেছে ইতিমধ্যে তিনটি সরকারী পাঠ্যবইও পেয়ে গিয়েছে বই উৎসব শেষে। আমি অপেক্ষায় আছি বাকি বইয়ের লিস্টির জন্য।
শীত প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। স্কুল শেষে আলিনার এখন প্রধান কাজ গায়ের সোয়েটার আর ব্যাগ আমার কাছে দিয়ে একছুটে মাঠে চলে যাওয়া। এরপর আরো কিছু বাচ্চার সাথে মিলে অহেতুক দৌড়াদৌড়ি করা। কখনো তারা নিজেরাই নতুন নতুন খেলা আর নিয়ম বানায়, আবার কখনো মুখের মাস্ক চোখে দিয়ে কানামাছি ভোঁ ভোঁ খেলায় মত্ত হয়।
আর আমরা কজন অভিভাবক মুগ্ধ চোখে আকাশী নীলের এই বয়ে যাওয়া দেখি সবুজ আর ধূসর মাঠে। আমাদের সময় কেটে যায়। আমি ভাবি আমার পিতার সাথে এরকম কোন স্মৃতি আমার আছে কিনা?
না, নেই। আমার শৈশবে আমাদের সান্ধ্য আইন ছিল শুধু। স্কুল বাদেও যে বাচ্চাদের মানসিক বিকাশে খেলা আর বইয়ের দরকার আছে সেটা আমার বাবা-মা জানতেন না। সান্ধ্য আইনে স্কুলের পর, আমরা দুপরে বাসায় ফিরে খাবার পরে মাঠে নেমে যেতে পারতাম। কিন্তু নিয়ম হচ্ছে সন্ধ্যায় মাগরিবের আযান দেয়া মাত্র বাসায় ফিরে আসতে হবে।
অনেক খুঁজেও স্মৃতির পাতায় আমি বাবার সাথে মাঠে খেলতে যাওয়া বা মুভি দেখতে যাওয়ার মত স্মৃতি খুঁজে পেলাম না। খুব কঠিন আর খটমটে লোকটা আসলে জীবিকার জোগাড়েই সবর্দা ব্যস্ত থাকতেন। তার পারিবারিক শিক্ষা তাকে শেখায়নি বাচ্চাদের সাথেও আনন্দ ভাগাভাগি করা যায়, কিংবা বলেনি আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে যাওয়া বাদেও আরো আনন্দ আছে বাচ্চাকে দেবার মত।
এখনও আমি মানি আমার বাবা ভুল করেছেন, আমি অনেক ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েছি। আমার শৈশব আরো সুন্দর হতে পারত। তারপরেও বাবাকে ভালোবাসি, তাই তার ভুল থেকে আমি শিক্ষা নিয়েছি। আমার সন্তানকে তাই আমি যা কিছু পাইনি তার সবটাই দিতে চাই।
স্কুল ছুটির পরে তাই তার এই দুরন্ত ছূটে চলা আমাকে অন্যরকম একটা ভালো লাগা দেয়। একদল “হাসিমুখ” আকাশী নীল রঙের জামা পরে ছুটছে, গায়ে লাগাচ্ছে এই পৃথিবীর রোদ, পাশে পাহারায় তাদের পিতা এবং মাতারা।
আহা শৈশব…।
ধুলো বালি মাখুক, রোদ্র-ছায়ায় বড় হোক, আমাদের ইট-পাথরের ইমারতে বন্দী না থাকুক।
|| দুই ||
বইমেলা…।
ফেব্রুয়ারী আসলেই আমার মনটা উচাটান হয়ে যায় একবার হলেও বইমেলায় যাবার জন্য। আমার ছোটবেলায় আমি বাবা-মার সাথে কোনদিন বইমেলায় যাইনি। তারা বিশ্বাসও করতেন না পাঠ্য বইয়ের বাইরে আর কিছু পড়ার দরকার আছে।
আমার বিশ্বাস আলাদা, আমি গড়ে উঠেছি তাদের ছায়া থেকে সরে গিয়ে। এই ব্যপ্যারটা মাঝে মাঝে আমাকে ভাবায়। আমি আমার বাবা-মা কারো মতই পুরোপুরি হয়ে উঠতে পারিনি। তাদের ধ্যান ধারনা আর আচরন আমাকে খুব একটা স্পর্শ করেনি। একজন মানুষ যার চিন্তা ভাবনা তার পারিবারিক শিক্ষা থেকে বেশ আলাদা, কিভাবে সম্ভব?
উত্তরটাও অনুমেয়, বই। কৈশোর থেকেই আমি পড়তে প্রচুর ভালোবাসতাম। আজকে আমার আমি হবার পেছনে বইয়ের অবদান অনেক বেশি।
আলিনাকে আমি নিয়ম করে প্রতিবছর বইমেলায় নিয়ে যাই। এবারও যাবে। কিন্তু আমি এখনও জানি না বইয়ের প্রতি প্রেম তার আদতেও তৈরি হবে কিনা। না হলেও ক্ষতি নেই, নতুন দুনিয়ায় শেখার জন্য আরো অনেক উপকরন আছে। সন্তানকে তার পিতা মাতার মত হতেই হবে এমন দিব্যি কেউ দেয়নি। সে তার নিজের মত বড় হোক। আমি শুধু আমার সাধ্যমত জগতের ভালোর সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই।
আমি নিজে প্রযুক্তি প্রেমিক মানুষ, আমার কন্যা বড় হচ্ছে তাই নিত্য নতুন প্রযুক্তি দেখে। কিন্তু তার মাঝেও চাই যতটা পারা যায় মাটির কাছাকাছি রুপটাও সে দেখুক।
শিশুদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাকে পাঠ্যবইয়ের পড়া শেখাবে, কিন্তু আমি চাই সেই সাথে এই আকাশী নীল বাচ্চাগুলো বৃষ্টির শব্দ শুনতে পাক, মাটিতে পোকা খুঁজুক, গায়ে মাখুক এই সূর্যের নীচের ধুলোবালি।
আলিনা এবং তার বন্ধুরা এই গ্রহের সবথেকে ভালো স্বপ্ন দেখুক।
আমি এবং আমরা যারা আমাদের শৈশব কাটিয়েছি অবহেলায় আর অযত্নে- সবাই তাদের সন্তানের মানসিক যত্ন নিন। আপনার পিতা বা মাতা ভুল করেছে বলে সেই ভুল আপনাকে বয়ে বেড়াতে হবে কেন?
আমাদের ধূসর হয়ে যাওয়া শৈশব বদলে যাক আকাশী নীলের ভালোবাসায়।
আলিনার স্কুলের প্রথম শ্রেনীর বিদায়ী ক্লাস পার্টি। ছবিতে তাদের শ্রেনী শিক্ষিকা সাবিনা ইয়াসমিন। অসম্ভব রকমের ধৈর্যশীল এই নারী কি অসাধারন ভাবে এতগুলো বাচ্চাকে সামলান সেটা দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি।
0 Comments