স্মৃতি সবসময়ই কাঁদায়। সুখের হোক, বা দুঃখের হোক – স্মৃতি মনে পড়লেই মনটা বিষন্ন হয়ে ওঠে। আমার নিজের স্কুলের কথা যখন আমার মনে হয় তখন অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে, সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি, আর ফিরে পাওয়া হবে না! সেই ভাবনাহীন শৈশব আর অবাধ্য কৈশোর আমাকে বিষন্ন করে তোলে।
আমি খোলা মাঠ পেয়েছিলাম, আকাশ, মাটি-ধুলো আর প্রকৃতিকে আপন করে নেয়ার একটা সময় পেয়েছিলাম। আমাদের সন্তানেরা সেরকমটা পাবে না। তাদের জগতের সময় কেড়ে নেয়ার জন্য আছে প্রযুক্তির অবাধ প্রবেশ।
আমাদের সময় মোবাইল, ইউটিউব আর ইন্টারনেট এত সহজলভ্য ছিল না। আমাদের শেখাটা ছিল তাই অনেক ধীর আর পরিমিত। কিন্তু আমাদের সন্তানেরা এখন যেকোন তথ্য চাইলেই হাতের কাছে পায় আর কিছু বিনোদন না চাইতেই পায়।
চিন্তা করে দেখুন, আমাদের ৯০ এর দশকে যদি করোনা মহামারী হত আর তার কারনে স্কুল বন্ধ দিতে হোত, তবে অনলাইন ক্লাস নেবার কোন উপায় ছিলনা। তখন হাতে হাতে মোবাইল আর তাতে অবাধ ইন্টারনেট ছিল না।
আমাদের স্কুলে শীতের যখন ছুটি দিত, আমরা তখন এলাকায় ক্রিকেট টুর্নামেন্ট এর আয়োজন করতাম। সারাদিনই ছিল অবারিত আনন্দে কাটানোর।
আমি সবসময়ই চাইতাম আমার মেয়ে এমন একটা জায়গায় পড়াশোনা করতে পারবে যেখানে মাটি আর মানুষের সাথে তার কিছুটা হলেও বন্ধন থাকবে। সু-উচ্চ দালান আর শীতল ঘর বাদেও শিক্ষার আদান প্রদান করা যায়, বরঞ্চ সেটাই মনে গেঁথে যাবে আজীবনের জন্য আমার ধারনা সেরকমই।
স্কুলের প্রথম দিনে তাই আলিনার থেকে তার বাবার উতসাহ হয়ত কিছুটা বেশি ছিল। আলিনা স্কুলে গিয়ে বই নিয়ে এসেছে তারপর বাবা-মার সাথে রিকশায় একটু ঘুরাঘুরি, স্কুলের মাঠ আর অন্য বাচ্চাদের সাথে ক্লাসের স্মৃতি – এসবের অনেক কিছু রয়ে যাবে তার অবচেতনে। আমার প্রথম স্কুলে যাবার স্মৃতিও আমার বেশ মনে আছে।
দ্বিতীয় দিনে স্কুল থেকে ফেরার সময় আমি যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম, স্কুলে কি হয়েছে আজকে? আলিনা মন খারাপ করে জানিয়েছে সেখানে একটা মাঠ আছে কিন্তু তাদেরকে খেলতে দেয়নি! সে দেখেছে অন্য বাচ্চারা সেখানে খেলছিল, এজন্য তার কিছুটা মন খারাপ।
আমি বুঝিয়ে বললাম, তুমি আজকে প্রথম গিয়েছতো তাই হয়ত খেলতে দেয়নি। যখন সবাই তোমার বন্ধু হয়ে যাবে, তখন তোমাকে খেলতে দেবে।
আসলে নতুন শ্রেনীর কাউকেই দ্বিতীয় দিনেও মাঠে খেলতে দেয়া হয়নি, দেবার কথাও না। করোনার কারনে অনেক অল্প সময়ের জন্য স্কুল চলছে, তাও সপ্তাহে একদিন, সেখানে নতুন শ্রেনীকে পাঠদানে অভ্যস্ত করার আগেই মাঠে ছেড়ে দেবার সময় কই?
একদিন ক্লাস আর বাকি দিন অনলাইনে পাঠদান, এভাবেই চলার কথা স্কুল। কিন্তু করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় হুট করেই আবার স্কুল বন্ধ হয়ে গেল, এখন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই স্কুল ড্রেসে মনিটরের সামনে খাতা-কলম নিয়ে বসে যাওয়া।
প্রথম দিন অনলাইনে ক্লাস করার আগে সে তার মাকে বলে রেখেছিল বাবাকে যেন ঘুম থেকে তুলে দেয় সময়মত কারন বাবা heavy sleeper.
আমি ঠিকই ঘুম থেকে উঠেছি, কিন্তু অনলাইন ক্লাসের এই ব্যবস্থা আমার ভালো লাগছে না। এখানে কোন শৈশব নেই, ক্লাসের বেঞ্চিতে দাগাদাগি নেই, যন্ত্রের মত কিছু মুখস্ত বিদ্যা আর লেখা, এর সাথে আনন্দের কোন স্মৃতি নেই।
আমরা আসলে অসহায় হয়ে দেখছি কিভাবে শৈশব চুরি হয়ে যায়। একদিন করোনা মহামারী শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু যে লক্ষ লক্ষ শিশুরা স্কুলের বারান্দায় নুয়ে পড়া রোদ দেখা থেকে বঞ্চিত হয়েছে, তাদের সে সময়টা আমরা আর ফেরত দিতে পারব না। যে শেখার সাথে কিছু ফুলের আর মাটির গন্ধও জড়িয়ে থাকার কথা আমরা কখনো সেটা মোবাইল আর পিসির মনিটরে তুলে আনতে পারব না।
আমাদের শিশুকাল হারিয়ে যায়, আমাদের স্মৃতিরা বেড়ে ওঠে না 🙁
অতীত স্মৃতি মনে করার মাঝে এক ধরনের রোমান্টিসিজম আছে। আনন্দের হোক আর দুঃখেরই হোক, স্মৃতি তাই সবসময়ই কিছুটা বিষন্ন করে তোলে আমাদের। আমাদের অবসরে অতীতের স্মৃতি মনে করে আমরা এই দুঃখটা পেতে ভালোবাসি। আজ যারা আমার আত্মার আত্মীয়, বন্ধু,সুহৃদ – তাদের সাথে আমার ভালো কিছু স্মৃতি আছে বলেই এখনো আমরা একে অপরের খোঁজ খবর নেই।
করোনা মহামারি আলিনার স্মৃতির সড়কে হরতাল বানিয়ে দিচ্ছে। শুধু আলিনা নয়, এ দেশের আরো লক্ষ লক্ষ শিশুরা তাদের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠা হারাচ্ছে। তাদের প্রথম স্কুল আনন্দের বা স্মৃতির কোনটাই হচ্ছে না।
শিশুকে প্রকৃতির মাঝে ছেড়ে দিতে হয়, শেখানোর দায়িত্ব প্রকৃতি নিজের হাতেই নিয়েছে। কিন্তু আমরা সেখানে যেতেও তাদের বাধা দিচ্ছি।
অফিস, আদালত, বানিজ্যমেলা সব চলবে, শুধু স্কুল, কলেজ বন্ধ, এ একটা ভীষন প্রহসন। তারপরেও আশা রাখি, ভবিষ্যত সবসময়ই আশার কথা বলে।
ভালো থাকুক তারার সন্তানেরা।
0 Comments