মানুষের মনন, ব্যক্তিত্ব এবং আমাদের সমাজ সব কিছু নির্ভর করে ব্যাক্তি হিসেবে আমরা কতটা সুখী বা সন্তুষ্ট তার উপর। একজন মানসিক ভাবে অসুস্থ মানুষ কখনই পরিবার, সমাজ বা দেশকে ভালো কিছু দিতে পারবে না।
ধরুন সকাল বেলা মন মেজাজ খারাপ করে অফিসের/ব্যবসার জন্য বের হলেন। কারন, গিন্নির সাথে ঝগড়া হয়েছে। আপনি খুব সহজেই আপনার এই রাগ ছড়িয়ে দেবেন রিকশওয়ালা, ড্রাইভার কিংবা আপনার অধিনস্ত অন্য কারো উপর। রাগ কোন না কোন ভাবে দমন করার চেষ্টা মানুষের মস্তিস্ক করবেই।
কিন্তু আদতেও এতে আপনার রাগ কমবে না। কারন যেখান থেকে রাগের উতপত্তি সমাধানও সেখান থেকে আসতে হবে।
দুপুরের পর গিন্নি ফোন করে আপনার খবর নিল হাসিমুখে, খেয়েছেন কিনা জানতে চাইল… ব্যাস আপনার মন কিন্তু ঠান্ডা। আপনি আবার সহজেই কাজে কর্মে মন দিতে পারলেন। সবার সাথে আবার হাসিমুখে ব্যবহার করা শুরু করলেন।
সেই একই আপনি, কিন্তু দু-রকম চরিত্র।
আমরা সবাই জানি এই ধরনের ঘটনা খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রতিনিয়ত আমাদের জীবনে ঘটে চলেছে। কারন একটাই ইমোশন বা আবেগ।
আমাদের আশেপাশের মানুষের মধ্যে কিছু লোকজন আমদের ইমোশন নিয়ন্ত্রন করে অন্যদের থেকে বেশি। যেমন পিতা-মাতা, বন্ধু, স্ত্রী-সন্তান। কারো কারো কারো ক্ষেত্রে এটা অন্য কেউও হতে পারে!
আর কিছু ইমোশন আমরা নিজেরাই নিয়ন্ত্রন করি।
এই যে ইমোশন বা আবেগের লাগাম তা কিন্তু আমরা নিজেরাই তুলে দেই অন্যের হাতে। যাকে বিশ্বাস করি, আস্থা রাখি যার উপর তার কাছেই বেশিরভাগ সময় আমাদের আবেগের নাটাই সুতো থাকে।
এদের কাছে আমাদের প্রত্যাশাও বেশি থাকে। কষ্টও মানুষ বেশি পেয়ে থাকে তাই এই কাছের মানুষের কাছ থেকেই।
মানুষ সবচেয়ে বেশি প্রতারিত হয় তার পরিচিত বিশ্বস্ত মানুষের দ্বারা।
কাদের কাছে আমরা আমাদের চিন্তা-ভাবনা শেয়ার করি?
মূল কথায় এবার আসা যাক। আমরা আমাদের গোপন, আসল-নকল, সুখ-দুঃখের সব কথা তার সাথেই শেয়ার করি যার হাতে আমাদের এই ইমোশনের নাটাই সুতো থাকে।
একটা সাধারন অভিযোগ আছে, ছেলেরা বিয়ের পর বউয়ের কাছে খুব বেশি কিছু শেয়ার করতে চায় না।
এর একটা প্রধান কারন হল, বিয়ের পর মেয়েরা আগের মত স্বামীর কথাকে পাত্তা দিতে চায় না বা গুরুত্ব দেয় না। সম্মান অনেক বড় একটা ফ্যাক্টর যা ইমোশনকে ত্বরিত প্রভাবিত করে।
আপনি যখনই দেখবেন আপনার স্ত্রী/স্বামীর কাছে আপনার কথা গুরুত্ব পাচ্ছে না, আগের মত সম্মান পাচ্ছেন না। তখন আপনার ইগো হার্ট হবে, সম্মানে লাগবে এবং এটা চেইন রি-একশনের মত আপনার ইমোশনাল ডিসব্যাল্যান্স ঘটাবে।
ফলে আপনি আপনার স্ত্রী বা স্বামীর কাছে ভবিষ্যতে আর কিছু শেয়ার করতে চাইবেন না।
আমাদের মন বলে আমরা তার কাছেই দুঃখের কথা বলব যে মন দিয়ে শুনবে, হাসাহাসি করবে না বা কটাক্ষ করবে না, এবং অনবরত আমি কত বড় বোকামি করেছি তা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে না।
আছে না এইরকম কিছু বন্ধু বা ব্যাক্তি আপনার লিস্টে? থাকতেই হবে… সেটা ভাই হতে পারে, বাবা হতে পারে কিংবা হতে পারে অনেক বন্ধুর মাঝখানে বিশেষ একজন। কারন দিন শেষে আমরা সবাই কাউকে না কাউকে আমাদের মনের কথাগুলো বলতে চাই। নিজের ভেতরের কষ্টগুলো ভাগাভাগি করতে চাই প্রিয়জনের সাথে।
সেই প্রিয়জন যদি পরিবারের কেউ না হয় তবে অবচেতনেই আমরা তার পরিবর্তে অন্য কাউকে খুঁজে নেই।
বেশিরভাগ পরকিয়াই শুরু হয় পরিবারের কাছের মানুষটার কাছে নিজের কথা একান্তে না বলতে পারার কষ্ট থেকেই।
কখন শেয়ার করি আমরা?
সেই আদিকাল থেকেই আমরা গল্প, কথা, গান, সংবাদ, জন্ম, মৃত্যু, গুজব ইত্যাদি শেয়ার করে আসছি।
যা কিছুই আমদের মস্তিষ্ককে স্টিমুলেট বা উদ্দীপত করছে তাই আমরা শেয়ার করছি। সোজা বাংলায় আমরা মানসিক ভাবে উত্তেজিত হলেই কোন সংবাদ বা ঘটনা শেয়ার করার চেষ্টা করি।
আমাদের মস্তিষ্ক একটা সুপার কম্পিউটারের মত কাজ করে। সে এটাও বলে দেয় কোন সংবাদ কার সাথে শেয়ার করতে হবে, কোনটার ঝুঁকি কেমন ইত্যাদি।
যেমনঃ প্রমোশনের খবর সবাইকে ফেইসবুকে পোস্ট করে জানিয়ে দেই আমরা, কারন এতে আমাদের সামাজিক স্ট্যাটাস বাড়ে। কিন্তু লটারিতে টাকা পেলে বা বিজনেসে লাভ হলে আমরা পাশের বন্ধু এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে বউকেও বলতে চাই না। আমাদের মস্তিষ্ক জানান দেয় এতে টাকা ধার দিতে হতে পারে।
এইখানেও কিন্তু ইমোশন বা আবেগ একটা বড় ভুমিকা রাখে। আমরা দুঃখি হলে খুব বেশি কিছু বলতে চাই না কাউকে। চুপচাপ থাকার চেষ্টা করি। আর যখন আমদের মন ভালো থাকে তখন নানা ধরনের জিনিসপত্র শেয়ার করে বেড়াই বন্ধু-বান্ধব এবং সোশাল মিডিয়াতে।
সোশাল মিডিয়ার পোস্টগুলো একটু দেখলেই বুঝতে পারবেন। কই ঘুরতে গেলাম, কি খেলাম, কোন মুভি দেখলাম… ইত্যাদি ধরনের পোস্টই আমরা বেশি করে থাকি। আরেক ধরনের পোস্ট মানুষ করে তা হচ্ছে হতাশার পোস্ট। কোথাও অন্যায়ের শিকার হয়েছে বা হচ্ছে এবং এর প্রতিকার কি এইগুলো নিয়ে পোস্ট।
আমাদের ব্যাস্ত জীবনে মনের কথা বলার মানুষ কমে যাচ্ছে দিন দিন, তাই সবাই সোশাল-মিডিয়ার হাতেই তুলে দিচ্ছে তার আবেগের নাটাই সুতো। এখানে এসেই ঘন্টার পর ঘন্টা কমেন্ট, লাইক এবং নিজের মনের কথা বলে বেড়াচ্ছে।
গুজবও এরকম একটা ইমোশনাল স্টিমুলেটর। কিছু মানুষ বুঝে হোক বা না বুঝে গুজব ছড়ায় কারন এই সংবাদ তার মস্তিষ্কে উত্তেজিত করে তোলে। সে নিজের চিন্তা-ভাবনার থেকে গুরুত্ব দেয় অন্যরা কি চিন্তা করছে বা ভাবছে সেটাকে।
সেই আদিকাল থেকেই পৃথিবীর সব দেশেই গুজব একটা বড়সড় সমস্যা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এসে এতে আগুনে পেট্রোল ঢালার মত পরিস্থিতি তৈরি করেছে মাত্র।
কি শেয়ার করব, কার সাথে করব, আদতেই করব কিনা? হয়ে যান সুপার হিউম্যান
অনেক তো ব্যাখ্যা দিলাম, এবার যথারীতি কিছু উপদেশ দান-খয়রাত করি। নেয়া না নেয়া আপনার হাতে।
প্রথম কথা, নিজের ইমোশনকে নিয়ন্ত্রনে রাখুন। আপনার আবেগ যেন অন্য কেউ নিয়ন্ত্রন করতে না পারে। না হলে যে কারো কথায় বা কাজেই আপনার মন মেজাজ খারাপ হয়ে যাবে আর তার ঝাল আপনি ঝাড়বেন অন্য কারো উপর।
বুদ্ধিমান ব্যাক্তিরা সহজে রেগে যান না। রেগে গিয়ে কাউকে কটু কথা বলার আগে একবার হলেও চিন্তা করে নেন। এরাই বাস্তবিক সুপার হিউম্যান। যারা নিজের আবেগ নিজের কন্ট্রোলে রাখতে পারে না, তারা জীবনেও উন্নতি করতে পারে না।
যখনই কোন একটা সমস্যা হবে, আগে নিজেকে শান্ত করার জন্য সময় নিন, তারপর দরকার হলে শেয়ার করুন কারো সাথে। উত্তেজিত আর মদপ্য অবস্থায় আমাদের বিচার-বুদ্ধি খুব একটা ঠিক থাকে না। তখন কি শেয়ার করা উচিত আর কার সাথে করা উচিত তা বুঝতে আমাদের ভুল হতেই পারে। এর খেসারত দিতে হতে পারে চরমভাবে।
আর যার সাথেই কথপোকথন করবেন তাকে সম্মান দিয়ে কথা বলার চেষ্টা করবেন। আপনার গল্প বলার ধরনই বলে দেবে শ্রোতা শুনতে রাজি কিনা! যেহেতু নিজের কথাই শেয়ার করবেন তাই ভুলেও শ্রোতাকে জড়াবেন না বা দোষারোপ করবেন না।
যেমন কখনই বলা উচিত নয়, তুই যদি আগেই আমাকে সাবধান করতি তবে আমি এই ভুল করতাম না।
এ কথার মানে আপনি স্পষ্ট ভাবে শ্রোতার উপর দোষ চাপাতে চাচ্ছেন। এইখানেই বিশ্বাসের সুতো ছিঁড়ে যাবে। আর যাকে আপনি বিশ্বাস করছেন না তাকে নিজের কথা বা আক্ষেপ কেন বলতে যাবেন? আরে সে-ই বা কেন শুনবে?
সবশেষে, সত্য বলুন। একবার যদিও কেউ বুঝতে পারে আপনি মিথ্যা বলে সিম্প্যাথি অথবা বাহবা নেবার চেষ্টা করছেন তবে আপনার ভ্যালু সেখানেই শেষ। আপনার সত্যি কথাতেও এরপর কেউ কান দেবে না।
লেখাটা অন্যভাবে (নেগেটিভ) নেবেন না। আমি প্রফেশনাল কোন সাইকোলজিস্ট নই। একান্তই আমার পড়াশোনা আর চিন্তা-ভাবনার ফসল এই লেখা। আমি শুধু চেয়েছে আমাদের চরিত্রগুলো একটু ব্যাখ্যা করতে।
একটা কথা মনে রাখবেন, আনন্দিত অবস্থায় কাউকে কোন কথা দেবেন না, আর রেগে গিয়ে কোন প্রতিজ্ঞা করবেন না। এ-দুটোই মারাত্বক।
0 Comments