অনেকদিন ধরেই ব্যপারটা আমাকে খোঁচাচ্ছে, ভালোবাসা কারে কয়? কৈশোর বেলায় মনে হোত কোন নারীর প্রেম মানেই ভালোবাসা।
কিন্তু যৌবনে এসে বুঝলাম ভালোবাসাটার অঙ্কটা অনেক জটিল। সারাজীবন খুঁজেও ভালোবাসার সন্ধান নাও মিলতে পারে।
ভালোবাসার সংজ্ঞাটা প্রত্যকে আলাদা ভাবে দিয়ে থাকেন। আমার সংজ্ঞা আমি এখনো খুঁজে বেড়াই এখানে ওখানে।
বাল্যকালে আমার প্রেম ছিল গল্পের বইয়ের দিকে। স্কুল পার করেছি লেখক হবার বাসনা নিয়ে। বঙ্কিম থেকে শরৎচন্দ্র তখন আমি গোগ্রাসে গিলি। সুনীলের কবিতা কিংবা উপন্যাস সবই অমৃত সুধার মত লাগত। হুমায়ুন ভক্ত যখন হলাম তখন অনেকটা পরিপক্ক হয়ে গেছি। ততদিনে আমার প্রেম জন্মে গেছে সায়েন্স ফিকশন আর আইজাক আসিমভে। আমার ভালোবাসার জায়গা ছিল শাহবাগের পাব্লিক লাইব্রেরী আর বাংলা একাডেমীর ভ্রাম্যমান লাইব্রেরীর গাড়ির চাকায়।
তখন ইচ্ছা পুষতাম একদিন যখন অনেক টাকা হবে আমি সব লেখকের বই কিনে ফেলব। একাকি নির্জনে আমার প্রেম চলবে বইয়ের পাতায় পাতায়।
নাহ, সেরকমটা এখন আর মনে হয়না। সেই রাক্ষুসে ক্ষুধার পাঠকের মৃত্যু হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে। পৃথিবীটাকে নতুন করে আবার দেখতে শিখলাম। বইয়ের জগতের বাইরের জগতের সাথে বেশি পরিচিত হতে লাগলাম। লাগাম ছাড়া স্বাধীনতা আছে, কিন্তু সেই সাথে আছে পকেটের টান। দুনিয়ার রুঢ় বাস্তবতার সাথে ধীরে ধীরে আমার পরিচয় হতে লাগল। টাকার প্রতি একটা ভালোবাসা আমার তখন থেকেই শুরু হয়ে যায়। আজীবনেও যা আর যাবে নাকি সন্দেহ আছে।
এই যৌবনে এসেই প্রেমে পড়ে গেলাম আমার বর্তমান সহধর্মীনীর। আমার ফাঁকা পকেটেও যিনি অনেক দুপুর, সন্ধ্যা (এবং রাত জেগে মোবাইলে) সময় দিয়েছেন তখন আমাকে। কি দেখে আমার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ছিলেন তা কখনো বলেননি আমাকে। কিংবা বোকা এই আমি বুঝতেও পারিনি। আমার পকেট ফাঁকা ছিল কিন্তু ভালোবাসায় কোন খাঁদ বা স্বার্থ ছিলনা।
তখন মনে হত এই নারীকে না পেলে জীবন বৃথা। কত অগুনিত দিন আমরা ঢাকার এ প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছি। এই ব্যস্ত ঢাকার সাথে আমার ভালোবাসা তখন আরো মজবুত হয়েছে। যেকোন তপ্ত দিন বা ভরা বর্ষাও তখন ভালো লাগত। প্রেমিকার সাথে ঝগড়ার পরে আবার স্বন্ধিকে ভালোবাসতাম। ভালোবাসতাম প্রেমিকার সাথে জুড়ে থাকা সব জিনিস। মনে হত এই শহরে অন্তত একজন আছে যে সারাদিনে একবার হলেও আমার কথা ভাবে।
আমি কৃতজ্ঞ এই নারীর কাছে আমাকে ভালোবাসার অন্যরকম এক সংজ্ঞা শেখানোর জন্য।
“প্রবলেম চাইল্ড” বলতে যা বোঝায়, তা আমি কখনোই ছিলাম না। ছোটবেলা থেকেই আমি নির্বিবাদে থাকতে বেশি পছন্দ করতাম। আমাকে নিয়ে বাবা-মার অভিযোগ তাই কখনই খুব বেশি ছিল না। তবে অভ্যস্ত হবার কারনে তাদের ভালোবাসার পরিমানটা তখন কোন ভাবেই আঁচ করতে পারতাম না। ভাবতাম আমাকে বোধহয় সবসময় ঠকানো হচ্ছে। সিলি মি…।
ছোটবেলায় আমার মা সবসময় একটা কথা বলতেন, “যেদিন নিজে বাবা না হবি, তার আগে বাবা-মার ভালোবাসা কখনো বুঝতে পারবি না।”
আজ আমি নিজে একটা কিউটের ডিব্বার বাবা হয়েছি। যার বয়স মাত্র দুই বছর হবে আসছে জানুয়ারিতে। আমি এখন বুঝতে পারি আমার মা তখন আমাকে কি বোঝাতে চেয়েছিলেন!
আমি নিজেও নিজেকে তৈরি করার চেষ্টা করছি যাতে কিউটের ডিব্বা বেশি টরচার করতে না পারে আমাকে। আশা করি আমি যা যা করেছি তার থেকে ২-৩ গুন বেশি করতে পারবে আমার মেয়ে। 🙂
সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের যে ভালোবাসা তা আমি এখন অনুভব করতে পারি। আমার থেকে বোধহয় আমার মেয়ের মায়ের ভালোবাসাটাই বেশি। তাই শাসনটাও সেই করবে। আমার ভালোবাসা এইখানে এসে আবার সংজ্ঞা বদলায়। মনে হয় একজীবনে অনেক কিছু পেয়েছি।
মেয়েকে সামান্য মশা কামড়ালেই মনে হয় দুনিয়া থেকে সব মশা নিশ্চিহ্ন করে দিই। যদি একটু ব্যথ্যাও পায় আমার মনটা অজানা আশঙ্কায় সারাক্ষন দুলতে থাকে। আশেপাশের সবাইকে তখন মনে মনে দুষতে থাকি দেখে না রাখার জন্য।
একদিন আমাদের ভালোবাসার মানুষগুলো আমাদের ছেড়ে চলে যাবে, কিন্তু আমাদের শিখিয়ে যাওয়া ভালোবাসা রয়ে যাবে। হৃদয় থেকে হৃদয়ে অদৃশ্য আলোক বর্তিকার মত তা ছড়িয়ে যেতে থাকবে।
ভালোবাসা এই রকমই। কোন নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় তাকে বেঁধে দেয়া যাবে না। সময় এবং ব্যক্তি ভেদে তার রুপ বদলায়। বদলায় তীব্রতা এবং রঙ। আচ্ছা ভালোবাসার রংটা কি? লাল, নীল না বেগুনি?
জানি না…, একজীবনে ভালোবাসার বাকি রঙ গুলোও দেখে যেতে পারব কিনা কে জানে!
মূহুর্ত হারিয়ে যেতে পারে, কিন্তু ভালোবাসার অনুভুতি নয়।
ভালো থাকুক পৃথিবীর মানুষেরা, ভালো থাকুক আমাদের ভালোবাসার মানুষগুলো।
0 Comments