আমাদের একটা অদ্ভুত সিস্টেম চালু হয়েছে – যারা সবকয়টা বিষয়ে এ+ পাবে তাদেরকে আমরা গোল্ডেন এ+ বলি। মানে তারা সোনালী আর সোনালী বাদে যারা আছে তারা হয়ত রুপালী, তামালী, লোহালী বা এরকম কিছু হবে। ফেইল করলে কি হবে জানি না, তাদের মনে হয় গোনায় ধরা হয় না, তারাতো মানুষই না। তুচ্ছ তেলাপোকা। (যদিও তেলাপোকা মানুষের অনেক আগে থেকে টিকে আছে এবং আমাদের পরেও টিকে থাকতে পারে।)
পুরো ব্যপারটির মাঝে আমি একধরনের অসুস্থতার লক্ষন দেখতে পাই। আপনার বাচ্চা যদি পরীক্ষায় খারাপ করে তাকে আপনি মারধর করবেন, বকাঝকা দিবেন বাসা থেকে চলে যেতে বলবেন ইত্যাদি ইত্যাদি। মেয়ে হলেতো কথাই নেই। হয়ত তাকে বিয়ে দিয়ে দিতে চাইবেন, না করে লাভ নেই। এইরকম ঘটনা আমাদের সমাজে হরহামেশা ঘটছে।
আসলে কি চান এইধরনের অভিভাবকেরা? বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা যা করতে পারেননি, তা সন্তানকে দিয়ে পুরন করতে চান। মানে আমি পারি নাই ডাক্তার হতে, তাই তোকে ডাক্তার হতেই হবে। আবার এরকমও হয় – আমি ডাক্তার তুই কেন ডাক্তার হবি না? কেউ কিন্তু একটা বারও ভাবে না তার ছেলে অথবা মেয়েটা আসলে কি হতে চায়?
কথা বেশি প্যাঁচায়া লাভ নাই, মুল কথায় আসি। লিখতে বসেছি গোল্ডেন কালচার নিয়ে। আমরা আসলে আক্ষরিক অর্থে একটা সোনালী প্রজন্ম রেখে যাচ্ছি। যারা কাগজে কলমে গোল্ডেন পেয়ে সোনার ডিম পাড়ার জন্য বসে আছে। প্রথমে তোমাদেরকে স্কুল পরীক্ষায় গোল্ডেন দেয়া হল এবং এর পর এইচ.এস.সি. তে আর তোমরা এবং তোমাদের অভিভাবকেরা খুবি খুশি হয়ে গেলে। কিন্তু তারপর গিয়ে দেখা গেল এইরকম সোনালীদের অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাতেই চান্স পাও না। ঘটনাটা কি? … …আর কিছুই না, এইখানে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে আর প্রশ্ন পত্র পাওয়া যায় নাই আগে। হুম… কি আর করা।
আমরা একটা প্রজন্ম জন্ম দিচ্ছি যারা মুখস্ত বাদে কিছুই পারে না, আর এদেরকে টার্গেট বেঁধে দেয়া হয়েছে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হবার জন্য। ফলাফল…… আবারো কিছু স্বপ্নভঙ্গ এবং আরো হতাশা। মাঝখান থেকে অবশ্য কোচিং সেন্টার ওয়ালাদের ব্যবসা ভালো যায়। এদের আয়ের পরিমান শুনলে আপনার চোখ কপালে উঠবে।
আমি নিজেও একটা সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম এবং আমি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি – কোচিং সেন্টার একটা ফালতু জিনিস। চান্স পাবার জন্য কোচিং সেন্টারের দারস্থ হতে হয় না। প্রয়োজন নিজের উপর বিশ্বাস।
কাজের কথায় আসা যাক, আপনার সন্তান কে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বানানোর জন্য যে মহাযজ্ঞের আয়োজন করেন এবং এ+ প্লাস না পেলে তাকে যেরকম মানসিক টর্চার করেন তা শুধু এদেশ বলেই করতে পারেন। বুকে হাত দিয়ে বলুনতো ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার বানানোর পরে আপনার লক্ষ্যটা থাকে কি? টাকা উপার্জন করা তাইতো? কারন এ+ পাওয়া না পাওয়া দিয়ে ভালো মানুষ না খারাপ মানুষ তা বিচার করা যায় না। আর অভিভাবক হিসেবে আপনার প্রধান লক্ষ্য কখনই থাকে না আপনার সন্তানকে একটা ভালো সচেতন মানুষ বানাবেন।
একটু কষ্ট করে যদি নেট ঘাটতে পারেন তবে দেখবেন – দুনিয়ার তাবত বড়লোক ব্যক্তিগনই এ+ অধিকারী ছিলেন না। এখন যাদেরকে দেখতে পান তাদের বেশিরভাগই স্কুল বা কলেজ ড্রপ আউট ছিলেন। তাদের ছিল সৃষ্টির নেশা। আমি এইরকম উধাহরন বিল গেটস থেকে মার্ক জুকারবার্গ – গন্ডায় গন্ডায় টানতে পারি। অথবা আমাদের দেশের ক্রিকেট খেলোয়াড়দের দেখিয়ে দিতে পারি। সম্মান, টাকা এবং খ্যাতি এদের সব কিছুই আছে।
আমরা একজন লিপুকে ধরে রাখতে পারি না, আমরা একজন জাহিদ হাসানের খবর রাখি না, আমাদের নোবেল বিজয়ী আমাদের কাছে তাচ্ছিল্লের উপহাস। আমি বাজি ধরে বলতে পারি আপনার ছেলে বা মেয়েকে যদি দেশের বা বিশ্বের শেষ্ঠ দশজন বিজ্ঞানীর নাম বলতে বলেন কিংবা জানতে চান সর্বশেষ কি আবিষ্কার হয়েছে চিকিৎসা বিজ্ঞানে তারা বলতে পারবে না। কারন এসব জিনিস পুস্তকে মুখস্ত করতে পাওয়া যায় না। এবার তাদেরকে হিন্দি ছবির গান কিংবা মুভির কোন অংশের কথা জিজ্ঞেস করুন, জানতে চান কোন সেলিব্রেটি কাকে বিয়ে করেছে- তারা গড়গড় করে বলে দেবে।
আমরা তোতাপাখি জাতি। মাত্র অর্ধশতকের ব্যবধানে যে জাতি তার ইতিহাস পরিবর্তন করে এবং তা নিয়ে প্রতিনিয়ত মারামারি করে, তারা সন্তানের গোল্ডেন এ+ পাওয়ার জন্যে এত উতলা হলে ব্যপারটা হিপোক্রেসি হয়। আমরা মনে করি ফিজিক্স বা ম্যাথ পড়ুয়া ছেলে বা মেয়েটা কিছু করতে পারবে না, এটা আমরা তাদের অবচেতনে ঢুকিয়ে দেই। আমরা চাই তারা শুধু মেডিকেলে বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়েই পান্ডিত্য অর্জন করুক। আমি বলছি না ইঞ্জিনিয়ারিং বা ডাক্তারি পড়ার দরকার নেই, কিন্তু সবাইকে এই হতে হবে এটা মনে করাটা অসুস্থতা। জাতি হিসেবে আমরা খুবি অসুস্থ। যে দেশে গুনির কদর নেই সে দেশে গুনি জন্মায় না, আর ভুলেও যদি জন্মায় তবে দেশত্যাগী হতে বাধ্য হয়।
আসুন না আমারা আমাদের পরিবার থেকেই শুদ্ধি অভিযান শুরু করি। সন্তান কে নিজের ইচ্ছা চাপিয়ে দেয়া থেকে বিরত থাকি। তাকে বলি তুমি চাইলেই পার ক্রিকেটার হতে, কিংবা বৈজ্ঞানিক, ফটোগ্রাফার, অভিনেতা, লেখক। জীবনটা অনেক বড়, তুমি যা পছন্দ কর তাই হতে পার। কে জানে হয়ত আমাদের দেশেই পরবর্তি স্টিভ জবস কিংবা জগদীশ চন্দ্র বসু্র উত্তরসূরির জন্ম হবে। তাহলে হয়ত আমাদের ফিজিক্স বা কেমিস্ট্রি পড়ুয়া ছেলে বা মেয়েটিকে গিয়ে ব্যাংক জবে তার মেধা যাচাই করতে হবে না। ঐ স্থানগুলো আমরা ছেড়ে দিতে পারব আমাদের ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় যারা আছে সেই সকল মেধাবীদের জন্যে।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়, আপনার সন্তানকে স্বপ্ন দেখাতে শিখুন। জীবনের প্রতিযোগিতায় তাকে অসম রেসে নামিয়ে দেবেন না।
পরিশেষে যারা সোনা, রুপা, তামা কিছুই পাও নাই তাদের জন্য –
ধরে নাও একটা রেস হচ্ছে, যার প্রতিযোগী দশজন। রেস শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত সবাই কিন্তু প্রথম হবার সম্ভাবনা রাখে। আমাদের দৃষ্টিতে সবাই তখন সমান, কিন্তু রেস শেষ হবার পরে একজন বাদে বাকিরা ফেইল। কারন প্রথম হবার অধিকার এবং যোগ্যতা একজনেরই থাকে। কিন্তু তাতে কি বাকি নয়জনের লজ্জায় মরে যেতে হবে। অবশ্যই না। প্রত্যেক প্রতিযোগিই সমান সম্মানের অধিকারী এবং কে জানে হয়ত সামনের রেসেই আরেকজন প্রথম হবে। আমাদের গোটা জীবনে এইরকম অনেকগুলো ছোট ছোট প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হবে। একবার হেরে গেছি বলে রেইস শেষ হয়ে গেছে এবং খেলা বন্ধ করে দিতে হবে এটা হতে পারে না। খেলা চলবে, প্রতিযোগিতা চলবে। সারভাইবাল অব দ্যা ফিটেস্ট এর রেইসে তারাই হেরে যাবে যারা মনে করবে খেলা শেষ।
বিঃদ্রঃ লাইফটাকে রেইস বলার জন্য দুঃখিত, যদিও আমাদের জন্য কিন্তু আসলেই তাই। ভালো থাকুক আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম।
0 Comments