নয়ডার নতুন বাসা
ভারতে অনেকদিন থাকতে হবে। জাসোলাতে থেকে কোনো ফায়দা নেই। এখানকার জীবন মোটামুটি নিরানন্দ।
তিনদিন আগে শাহরুখকে সাথে নিয়ে নয়ডাতে একটা বাসা দেখে আসলাম। ভাড়া প্রায় ৭০ হাজার রুপি চাচ্ছিল। বাঙালি মুসলমান বলে নাকি অনেকেই ভাড়া দিতে চায়না। ফ্ল্যাটটা আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। হাসপাতাল থেকে বেশ কাছেই। আমার প্রতিদিনের যাতায়াত ভাড়া বেঁচে যাবে।
নিরিবিলি একটা ছিমছাম পরিবেশ, অনেকটা আমাদের উত্তরার দিকে করা রাজউক প্রজেক্টের মত। পুরো ভারত জুড়ে এরকম অনেক আবাসন প্রকল্প আছে প্রাইভেট খাতে। এরা বিশাল জায়গাজুড়ে একেকটা সোসাইটি গড়ে তুলেছে। এই প্রজেক্টের নাম “কেন্দ্রিয় বিহার।”
জাসোলাতে হোটেল রুমে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে একটু পাশেই “প্যাসিফিক শপিং মলে” গিয়েছিলাম। এটা আমার গুগল ম্যাপ দেখে খুঁজে বের করা। আমি চমতকৃত হয়েছি। ভারতে মফস্বল এরিয়াতেও এরকম আধুনিক মল আশা করিনি। ছোট কিন্তু সুন্দর। সব ধরনের রিটেইল এবং ফাস্ট ফুডের ব্রান্ড আছে।
আরেকটা জায়গা আছে এখানে ঘোরার মত। লোটাস টেম্পল। এটার সামনে বড় বাগান দেখেছি। তবে এখন ডিসেম্বরের শেষ হওয়াতে ধুলো বালি আর মলিন সব ঘাস। মন্দিরটা পদ্মফুলের আকৃতিতে করা।
আমি যেখানটায় আছি তার আশেপাশে সকাল বেলা বেশ ভালো সবজি আর ফল পাওয়া যায়। আমাদের দেশের অজপাড়া গাঁ বলতে যেটা বোঝায় আদতে সেটা না। তবুও এটা একটা গ্রাম।
ঘুরতে আসলে আপনি একটা জিনিস বেশ ভালোভাবে বুঝতে পারবেন, ঢাকার মূল শহরেও আমরা এমন অনেক সুবিধা পাইনা যা এখানে অনেক দূরের শহরগুলোতে আছে। ভারতকে গালি দেবার আগে তাই ১০ বার নিজদের দৈন্যতা নিয়ে ভাবা উচিত। আমরা শিক্ষায় এবং প্রযুক্তিতে তাদের থেকে বেশ পিছিয়ে আছি।
ইয়াথার্থ হাসপাতাল (Yatharth Multi Specialty Hospital)
হাসপাতাল নিয়ে কেন লিখছি? আমার এবারের ভিসা মেডিকেল ভিসা, এসেছিও সেই কাজে। আমরা বাংলাদেশিরা উঠতে বসতে ভারতকে গালি দিলেও চিকিৎসার জন্য এই দেশেই আসতে হয়। নয়ডার ইয়াথার্থ হসপিটালে এবার ডাক্তার দেখাতে এসেছি।
শাহরুখ সারাদিন আমার সাথে ছিল। সে নিজেই নানা জায়গায় দৌড়াদোড়ি করছে আমাদের কাগজপত্র নিয়ে। যদিও এই কাজগুলি আমি নিজেই করতে পারি। মৌলানা হলেও এই কাজে তাকে বেশ পটু মনে হচ্ছে। দিন শেষে তাকে মোটেও বিরক্ত হতে দেখিনি, তবে কিছুটা বিধ্বস্ত লেগেছে। তার ব্যবহারের অমায়িকতা সে বজায় রেখেছে।
হাসপাতালটা বাইরে থেকে দেখতে যেমন সুন্দর, ভেতরেও তাই। প্রচুর বাঙ্গালী রোগীর সাথে সাথে অন্য প্রদেশ থেকেও মানুষজন আসে। তবে হরিয়ানা আর ইউপির লোকজনই বেশি।
একটা অদ্ভুত বিষয় দেখলাম আমি, এখানকার ডাক্তাররা বেশিরভাগই লম্বা, চওড়া আর ফর্সা। দেখলেই চেনা যাচ্ছে যে এই মোটাসোটা ফর্সা লোকটা ডাক্তার।
আলিনা খুব বিরক্ত হচ্ছিল। মাকে ছেড়ে কোথাও না নড়ার চক্করে তাকে সারাদিন হাসপাতালে কাটাতে হয়েছে।
হাসপাতালে ক্যান্টিনের খাবার বলতে সব ভেজিটেরিয়ান। যদিও এদের ঘাস-পাতা ভরে দেয়া স্যান্ডউইচ ও খেতে খারাপ লাগেনি।
হাসপাতাল দেখে শুধু আফসোস হয়, আহা আমাদের দেশেও যদি এরকম মেডিক্যাল ট্যুরিজম গজাতো! দেশ ছেড়ে অযথাই আমাদের এতদুর আসতে হোত না।
বাসা বিপত্তি
নয়ডায় যে বাসাটায় আমাদের ওঠার কথা ছিল সেটা পাইনি। শেষ মূহুর্তে নাকি ফ্ল্যাট মালিক ঠিক করেছেন তিনি মুসলমানদের বাসা ভাড়া দেবেন না! কিন্তু এখানকার দালাল আমাকে সেটা জানায়নি। আমি হোটেল ছেড়ে দিয়ে ১৫ কিমি এসে শুনি এই কথা।
মর জ্বালা…। সব কিছুতে ধর্মের ক্যাচাল ভালো লাগে না। পৃথিবীর মানুষের খুব দরকার এই অহেতুক কাজকর্ম থেকে বেরিয়ে আসা।
শেষে উপায় না দেখে আবার একটা হোটেলে উঠলাম। এটা হাসপাতালের পাশেই। কিন্তু আবাসিক এলাকার ভেতরে হবার কারনে বেশ অনেকটা ঘুরে যেতে হয়। Opulent Inn. নামের এই হোটেলটা বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে বেশ গোপন কোন সরকারি দফতর।
আমি ব্যাক্তিগতভাবে যেকোন জায়গায় গেলে দালাল এবং মিডলম্যান থেকে দূরে থাকি। আমার স্ত্রীর কারনে যেটা এবার সম্ভব হয়নি।
নতুন বাসা দেখিয়েছে দালাল আমাদের, সেটা মোটামুটি চলনসই। দেখা যাক এবারে কি হয়। এদের উপর এখন আর ভরসা করা যাচ্ছে না।
আনন্দ আশ্রয় সোসাইটি
আনন্দ আশ্রয় সোসাইটি নামের একটা জায়গায় নতুন বাসায় উঠেছি। এই বাসাটা অনেক পুরনো। অনেকটা বাধ্য হয়েই উঠতে হয়েছে। নয়ডাতে যে নতুন বাসা দেখিয়েছিল তার তুলনায় এটা আদিম যুগের। টয়লেট, কিচেন অপরিষ্কার, জানালার পাল্লা নেই। রাতের বেলা হুহু করে বাতাস ঢোকে। তাপমাত্রা প্রায় ৯ ডিগ্রি নেমে যাচ্ছে রাতে এখানে। আমাদের আগে এখানে বেশ কবছর কবুতরের খোঁয়াড় ছিলো। রাত হলেই তারা এসে জানালায় টোকাটুকি করতে থাকে।
দালালদের বলতে বলতে প্রায় অতিষ্ঠ হয়ে গেছি। এরা করে দিচ্ছি বলে হাওয়া। নিজে একা হলে আমি এসবের থোড়াই কেয়ার করতাম। যেদিকে দুচোখ যায় আর ভালো লাগে সেখানেই চলে যেতাম। কিন্তু সাথে পরিবার থাকায় এরা মনে হয় আমাকে পেয়ে বসেছে।
একটা রুম হিটার কিনে নিয়েছি। নাহলে রাতের বেলায় বসে থাকা যায় না।
এখানেও মজার কিছু ঘটছে না, বরঞ্চ আমার ক্লান্তি বাড়ছে। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে খরচ।
আগে ভাবতাম আমাদের দেশের দালালেরাই বাটপার, নয়ডায় এসে আমি তার থেকে বড় লেভেলের দালালের খপ্পরে পড়ে গেলাম।
এদের একজনের নাম নাফিস আলি, আরেকজন সুন্দর। ওবায়েদ ভাইয়ের কথায় আমি তাকে একমাসের বাসা ভাড়া অগ্রিম দিয়েছি। টাকা নেবার সময় এরা বলে “সাব কুছ হো যায়েগা” – কিন্তু এরপর সারাদিন আর দেখা নেই।
আমি বোঝা স্বত্তেও কেন তাদের এড়িয়ে যাইনি সেটার অন্য ইতিহাস আছে। মাঝে মাঝে অনেক বোকার সাথে আমাকেও বোকা সাজতে হয়। মানুষ আজীবন চেষ্টা করলেও কিছু কিছু বোকা মানুষকে শোধরাতে পারবে না।
তোমাকে বোকা বানানো হয়েছে- এটা মানুষকে বোঝানোর থেকে, তাকে আবার বোকা বানানোটা সোজা।
যেখানে উঠেছি সেখানকার বিল্ডিংগুলোর নাম চমৎকার, আমার ফ্ল্যাটটা পঞ্চম তলায়। এই বিল্ডিং এর নাম গাংগোত্রি-১। হিমালয়ের প্রবাহের নামে। একসময় বেশ আলিশান একটা স্থাপনা ছিল, এখন কালের বিবর্তনে শুধু কংকালটাই আছে।
এরা আমদের ফ্লাটে তোলার আগে ভালো করে পরিষ্কার করেনি। বারান্দাগুলো কবুতরের মলমূত্রে ভরা।
এলাকাটা হাসপাতালের খুব কাছেই। চাইলেই হেঁটে আসা যায়। আমরা অটোতে আসি ৫০ রুপির মত লাগে। আর উবারে আসলে ১২০ রুপি। পাঁচতলার বারান্দায় দাঁডিয়ে উপর থেকে সকাল আর রাতে বেশ কুয়াশা দেখা যায়। এত কুয়াশা আমি ঢাকায় দেখতে পাইনি, মন্দ লাগে না। তবে হাঁড় কাপানো ঠান্ডা, তাই বেশিক্ষন বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না।
দিল্লীতে মনে হয় স্থানীয়বাদে বাসা ভাড়া খুব একটা দেয়না। ওবায়েদের ভাষ্যমতে মুসলমানদের বাসা ভাড়া নাকি দিতে চায়না। তবে আমার যতদূর ধারনা এই হিন্দু মুসলিম সমস্যা এরা ইচ্ছে করেই আমাকে শোনায় যাতে আমি আতংকিত হই। কিন্তু আমার চেহারার নির্লিপ্ততা তাদের হতাশ করে। আমি ধর্মের ব্যাপারে কিছুটা উদাসীন, এখানে এসে এই চক্করে পড়ার কোন ইচ্ছা নেই আমার। এটা নিয়ে বিশাল গল্প বলা যায়। আপাতত সেটা অন্যদিনের জন্য তুলে রাখলাম।
কিন্তু এই দালালেরা এটাকে পূঁজি করেই তাদের ব্যবসা চালাচ্ছে। এটাও একধরনের ধর্ম ব্যবসা।
খাবার দাবার যেহেতু নিজেরা রান্না করতে পারছি, সেদিক থেকে কিছুটা বাঁচা গেছে। সারামাস বাইরের খাবার খাওয়ার বিশাল ঝক্কি আছে। স্বাস্থ্য এবং পকেট, উভয়ের জন্যই ক্ষতিকারক।
ভারতে সবজির দাম আমাদের ঢাকা শহরের থেকে অনেক কম। দেশ থেকে নিয়ে আসা মশলায় যখন রান্না হয় মনে হয়ে এইতো আর কিছুক্ষন পরেই খেয়ে দেয়েই বাইরে গিয়ে আড্ডা দিতে পারব।
আমি এই একমাসেই বেশ হাঁপিয়ে উঠেছি, কারন যে কাজে এসেছি সেটা নিরানন্দ। এর আগে কতবার ভারত এসেছি, প্রতিবার মনে হয়েছে আরো কিছুদিন থেকে গেলে ভালো হোত, এবার মনটা শুধু পালাই পালাই করছে।
কারন আমি যাদের সাথে এসেছি এরা কেউই ট্রাভেলার মেন্টালিটির নয়। এরা আরাম খোঁজে, তাও বেশ স্বস্তায়, তাই পদে পদে পস্তায়।
হাসপাতালের কাজ শেষ হলে তাই, বাসায় ফেরত আসি আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। এসে ল্যাপটপ বা মোবাইল নিয়ে বসে পড়ি পড়ার জন্য। নিজের ক্যামেরা নিয়ে এসেছিলাম কিছু ভিডিও রেকর্ড করব বলে, সেটাও ইচ্ছে করে না। ট্রাভেল ভিডিও করার জন্য যেরকম স্বতঃস্ফুর্ত থাকা লাগে এইবার আমার সেটা নেই।
দ্যা ভেনিস মল
কিছুটা একঘেয়ে রুটিন বদলানোর জন্য গতকাল ঘুরতে গিয়েছিলাম এখানকার একটা শপিং মলে। গালভরা নাম, “দ্যা ভেনিস মল”। ভেবেছিলাম ইতালির ভেনিসের শহরের আদলে করা কিছু হবে। অন্তত গুগল রিভিউ তাই বলছিলো।
বেশ হতাশ হয়েছি গিয়ে। আমাকে আমার গিম্বল ক্যামেরা নিয়ে ঢুকতে দেয়নি। অথচ সবাই মোবাইল নিয়ে যাচ্ছে। তাকে যতই বোঝাই আমি এই ভীড়ে ক্যামেরা ব্যবহার করব না, আর এটা মোবাইলের মতই, কে শোনে কার কথা! শেষ পর্যন্ত সিকিউরিটির কাছে ক্যামেরা জমা রেখেই আমাকে ঢুকতে হলো।
জানুয়ারির ১ তারিখ হওয়াতে কিনা কে জানে, পঙ্গপালের মতো মানুষ। কোথাও শান্তিতে একটু দাড়ানোর জায়গা নেই।
এমন আহামরি কোন জায়গা না হলেও মানুষ এই ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়েই ছবি তুলছে। ভারতে বেশিরভাগ শপিং মলেই এমেক্স কার্ড চলে। টুকিটাকি কিছু জিনিস কিনলাম। জামাকাপড়ের দাম এত বেশি যে আমার কিনতে ইচ্ছে হলো না। এদিক থেকে চিন্তা করলে বাংলাদেশে অনেক কম দামে একই ধরনের জিনিসপত্র পাওয়া যায়।
0 Comments