আমাকে বন্ধুদের অনেকেই বলে আমি নিজে চাকুরী করি না বলেই নাকি আমি সবসময় এর বিরুদ্ধে কথা বলি। আমি নাকি চাকুরীজীবিদের যথাযথ সম্মান দেই না।
তাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি আমার বাবা একজন সরকারী চাকুরীজীবি ছিলেন, এখন রিটায়ার্ড। আমি আমার জীবনকালে চাকুরীরত অবস্থায় তাকে কখনও স্বচ্ছল এবং হাসিমুখে দেখি নাই। আমার অবেচতন বলে চাকুরী করা বেশিরভাগ মানুষই গোমড়া মুখ করে রাখতে পছন্দ করে আর বয়স একটু পড়তির দিকে হলেই কিডনি বা হার্টের ব্যারাম বাধিয়ে বসে।
ডায়বেটিকস আর প্রেসারের কথা নাহয় নাই বললাম। এই দুইটা বাঙালির কাছে ডাল ভাতের মতন।
আরো মানছি, যারা বিসিএস দেয় তাদের আমি দুই চক্ষে দেখতে পারিনা। আমার চেনাজানা, ভালো-খারাপ সব রকম ছাত্র, জুনিয়র, বন্ধু, সহপাঠী একবার হলেও বিসিএস দিয়ে ভাগ্য পরীক্ষা করে দেখেছে। তাদের সেই নিদারুন খাটুনি আমি দেখতাম আর হাসতাম। অনেক বছর যাবত তো বিসিএস আসলে কি সেটাই আমার কাছে পরিষ্কার ছিল না।
বিসিএস দেয়া পোলাপাইন আমাদের পঁচে যাওয়া সিস্টেম পরিবর্তন করতে পারে নাই। এক ধরনের উচ্চশ্রেনীর দাস হইছে। আরো কঠিনভাবে বলতে পারতাম কিন্তু অনেকের ইগো হার্ট হবে। ইগো আবার আমাদের পশ্চাতদেশে ভরপুর থাকে। নাইলে একটু হইলেই রামদা নিয়া কোপাকুপি অথবা মামলা করার ভয় দেখায় নাকি?
যাদের শিক্ষক হবার কথা ছিল, অথবা বিজ্ঞানী কিংবা সমাজ পরিবর্তক, তারা হইছে সরকারি আমলা। এই আমলাতান্ত্রিক জটিলতা যে কি জিনিস এর মারপ্যাঁচে যে একবারও পড়ে নাই সে বুঝবে না। হারামীপনা আর নির্লজ্জতার কোন স্তরের আছে – তা এদের না দেখলে বোঝা যাবে না।
শিক্ষকদের কথায় মনে পড়ে গেল, একসময় আমার ধারনা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষকরাই হয়ত ধোয়া তুলসিপাতা। তারা সবচেয়ে মহান পেশায় নিয়োজিত থাকেন। তারা কোন রকমের অন্যায় করেন না আর প্রশ্রয়ও দেন না।
ভূল, এরাও ব্যাপক ধরনের লেজুড়বৃত্তিতে যুক্ত থাকেন। আর যারা নাই, তারা মূলত দরিদ্র এবং বেশ সরলসোজা। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় রাজনীতি এবং মারামারি, কাটাকাটি মূলত এরাই কন্ট্রোল করে থাকেন। কোন ছাত্রের সাহস নাই এদের ছায়ায় না থেকে রাজনীতি করার। এরাই বলে “করে যাও আমি আছি তোমার সাথে”।
আফসোস… আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষনার থেকে দলাদলি আর চামচামিই বেশি হয়। কে কোন দলের তাই নিয়ে চলে পদ দখলের প্রতিযোগিতা। ছাত্রদের মাথার উপরের অভিভাবক হবার কোন বাসনা তাদের নেই। এইখানেও কর্পোরেট কালচারের ব্যাপক ছোবল।
কর্পোরেট কালচার কি সেটা বিস্তারিত বলে বোঝানোর কোন দরকার নেই। এক কথায় কে কার পু… মারতে পারবে তার একটা প্রতিযোগিতা চলে। যার লেহন ক্ষমতা ভালো সে সবার উপরে যাবে। কখনো খাবে কখনো দেবে এটাই এখানকার মটো।
বুঝতে পারছেন না? আপনার কোন ব্যাংকার বন্ধু থাকলে তাকে জিজ্ঞেস করুন “বুকে হাত দিয়ে বল তোর চাকুরীতে কি তুই সুখী? এই সকল সুটেড বুটেড মেকি হাসির আড়ালে আসলে কি হয়?”
আমার বন্ধু কষ্টের হাসি দিয়ে বলেছিল “তুই মনে হয় বেশ ভালো আছিস?”
আমি বলেছিলাম, “ভালো খারাপ আপেক্ষিক বিষয়, এখন যেটা ভালো সেটা একটু পরেই আবার খারাপ হতে পারে। কিন্তু আমি জানি আমাকে প্রতিদিন বাস, রিকশা আর মানুষের জঞ্জাল ঠেলে বাধ্যতামূলক ভাবে অফিস নামক জেলখানায় যেতে হয় না, হাত জোড় (প্রতীকী) করে স্যার স্যার বলে কাউকে সম্বোধন করতে হয় না। তার বউ বাচ্চার জন্য গিফট কিনতে হয় না, তারা কেমন আছে সেটা জেনেও আমার কোন ফায়দা নেই। মুখে অহেতুক হাসি ঝুলিয়ে মেকাপ করে গালমন্দ শুনতে হয় না।”
বন্ধুর চেহারা দেখার মত হয়েছিল।
আগেই বলেছি আমার এই লেখা আপনার পড়ার দরকার নাই যদি ইগো সমস্যা থেকে থাকে।
টাকা দরকার এবং চাকুরী বাঁচিয়ে রাখতে যা যা করা দরকার এই কর্পোরেট পতিতারা তাই করে, বা বলা যায় বাধ্য হয়ে করে।
ভাই চাকুরী করা কি খারাপ?
– না অবশ্যই না। কিন্তু তেলামির যে কালচার তা অবশই খারাপ।
আমাদের কর্পোরেট পতিতারা তার জীবন বেঁচে খায়। যে সময়টা তার পরিবারের প্রাপ্য ছিল তা সে কোম্পানীকে বেচে দিয়ে টাকা উপার্জন করে। এক সময় এটা অভ্যাসে পরিনত হয় এবং ছাড়তে গেলেও পারে না।
হাত তোলেন এবং বলেন কে কে তার অফিসকে ভালোবাসেন? অফিস ছয় মাস বেতন না দিলেও মনের আনন্দে যাবেন কাজ করতে? সেই সকল মহামানবদের পদধুলি নিয়ে নিজেকে ধন্য করি।
আমি কি এর বাইরে?
নাহ, টাকার জন্য আমিও কাজ করি। কিন্তু আমি কাউকে তেল দেই না। কারো দয়ার উপর আমাকে নির্ভর করতে হয় না। উপরওয়ালার কথা আলাদা। তাকে যেখানে সেখানে টেনে নামাবেন না।
খালি ব্যাংকের কালচার এর কথা বলছি বলে মাইন্ড করবেন না। সব বড় বড় কোম্পানিতে মোটামুটি একই কালচার। কে কোথায় আংগুল দিলে কার জ্বলবে তাই দেখার অপেক্ষায়।
– এমডি আসে নাই বলে শ্রমিকেরা বেতন পাবে না।
– সামনে ছুটি থাকবে বলে এই শুক্র বা শনিবারেও কামলা দিতে হবে।
– প্রমোশনের জন্য দুই-একজনের সাথে শুইতেও সমস্যা নাই।
– যেহেতু ৩৬৫ দিনের ২৫০ দিনই অফিসে থাকি তাই কলিগের সাথে একটু আধটু প্রেম করাই যেতে পারে।
বহুত খাচ্চড় আছে অফিসে বসের ঝাড়ি খাইয়া বাসায় আইসা বউ-বাচ্চা পিটায়। অংকে কম পাইসে কেন এই জন্যে পোলাপানদের নির্যাতন করে।
হারামজাদা তুই কি বিদ্যাসাগর আছিলি এই বয়সে? বিদ্যাসাগরই যদি হবি তবে কেরানিগিরি করস কেন?
স্যারের সাথে হাসি-হাসি মুখ করে সেলফি তোলে, কিন্তু নিজের বাচ্চা কিছু বললেই মাইর।
সেই যে বৃটিশরা আইসা চাকরীর একটা কালচার ঢুকাইয়া দিয়া গেছিল সেইটা বাঙ্গালী এখনো প্রসব করে। কেরানীগিরি আপগ্রেড হইয়া কর্পোরেট কালচার হইসে।
যে সন্তান বড় হয়েছে বুয়া আর ডে-কেয়ার সেন্টারে। যে তার বাবা-মা কে শুধু দেখে রাতের বেলা। তার কাছ থেকে কর্পোরেট আচরনের জন্য অপেক্ষা করুন। এই কর্পোরেট কালচার আপনাকে রোবট বানিয়েছে, আমাকে করেছে দাস। আমরা ভালোবেসে কাজ করি না, টাকা পাই দেখে কাজ করি। আরো বেশি টাকার জন্য ঘুষ খাই। আর আমাদের সন্তানেরা বড় হয়ে এই টাকায় ইয়াবা খাবে।
আপনার কাজ আর পরিবারের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য রাখুন। পরিবার সব থেকে আপন সেটা যখন বুঝবেন ততদিনে অনেক দেরি হয়ে যাবে।
একটা কথা আছে না, কোন ছেলেই তার বাবার কথার অর্থ বোঝে না বা মূল্যায়ন করে না, যখন করে তখন সে নিজেই সন্তানের বাবা।
যে জীবন যাপন করার জন্য আপনি কর্পোরেট হয়েছেন, তালু চাঁটছেন আপনার উপরতলার, কখনো শরীর দিচ্ছেন বা কখনো জীবনের মূল্যবান সময়, তা আসলেই কতটা দরকারি ছিল?
পাঠ প্রতিক্রিয়া
এডিটঃ পোস্ট পড়ার পর বন্ধুর মন্তব্য
EXCELENT
সত্যি কথা, কিন্তু এরা এখন এমনভাবে ফেসে গেছে যে আর বেরোতে পারবে না। “এ খাচা ভাংবো আমি, কেমন করে?”