জবানবন্দী –

Jan 9, 2021প্রবন্ধ, সাহিত্য0 comments

লেখকের আসলে সংসার করতে নেই। প্রেমে পড়তে নেই, মায়ায় জড়াতে নেই।

নিত্যদিনের ঝামেলা পূর্ন জীবন লেখকের জন্য নয়। তার কলমের গতি রোধ হয়ে যেতে পারে জগত সংসারের এরকম কোন কিছুতেই তার আসলে জড়াতে নেই।

পরাধীন জীবনে যেমন বেঁচে থাকার স্বাদ পাওয়া যায় না, তেমনি মায়ার বন্ধনে বাঁধা পড়ে লেখকের কলম যদি বাধাগ্রস্থ হয়ে যায় তবে তার আর লেখা হবে না। যা হবে সেটা রোজনামচা।

বেঁচে থাকার জন্য অনেকেই চাকুরী করে, কিন্তু সেটা শুধু বেঁচে থাকার জন্যই, ভালোবেসে নয়। যে লেখা ফরমায়েশী হিসেবে আসবে, প্রতিদিনের বাজারের তেল, নুন, চিনি, ডাল-চালের হিসাব মেলানোর জন্য আসবে, সেটাকে সাহিত্য বলতে আমার কিঞ্ছিত আপত্তি আছে।

তবে কি লেখকেরা পয়সা ইনকামের জন্য লিখবে না?

আলবত লিখবে, কেন লিখবে না। এইখানে একটা সুক্ষ তফাত আছে। আমি লিখে পয়সা উপার্জন করি, আর পয়সা উপার্জনের জন্য লিখি – এই দুটোতেই পয়সা উপার্জন হলেও পরেরটাতে ভালোবাসার অভাব আছে। যেখানে ভালোবাসার অভাব থাকবে সেখানে একখাটে ঘুমানোটাই হবে, সংসার হবে না। একজন লেখক, কবি বা প্রাবন্ধিক তার লেখার সাথে সংসার করেন। সে সংসারে আর কেউ থাকে না। লেখকের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা, কলম, কিবোর্ড বাদে বাকি সবই তার সতীন।

প্রতিদিন যদি বাজার করতে যেতে হয়, প্রেমিকার বা বউয়ের আবদার মেটাতে হয়, মিথ্যে করে হলেও হাসিমুখে বলতে হয় ভালো আছি… আপনি কেমন আছেন? – তবে সেটা লেখক হিসেবে আমার ব্যর্থতাই বাড়াবে।

সব লেখকই আশা করেন একটা নির্ঝঞ্জাট পরিবেশে থাকতে পারবেন। নিজের চিন্তা আর ব্যক্তিত্ব দিয়ে তার দেয়াল তোলা থাকবে। সেখানে দরজা থাকলেও তা সবসময় বন্ধই থাকবে। খুলবে শুধু লেখকের ইশারায়। আপনি ভুলেও সে দরজায় আঘাত করবেন না। আর অহেতুক দেয়াল ভাঙ্গার চেষ্টা করেও লাভ নেই। এই দেয়াল ভাঙ্গে না, শুধু সেই লেখক মন আরো দূরে সরে যেতে থাকে আপনার কাছ থেকে।

লেখালেখি অনেক আবেগের বিষয়, আবেগটা সবাই ধরতে পারবে সে বৃথা চেষ্টাও করি না। কিন্তু অনবরত যখন নানাবিধ পারিবারিক এবং সামাজিক কারনে আপনার সে আবেগে ভেজাল মিশে যায় তখন কলমের ধার কমে যেতে বাধ্য। এখন কিছুটা হলেও বুঝতে পারি প্রাচীনকালের মুনি-ঋষির দল কেন সমাজ ছেড়ে নির্জনে চলে যেতেন ধ্যান করতে।

গৌতম বুদ্ধ সংসার বিবাগী হয়েছিলেন জগত সংসারের রহস্য বোঝার চেষ্টায়।

লেখকের গল্পে, কবিতায় বারংবার চলে আসে নানা ধরনের মানব-মানবীর সম্পর্ক, আচরন আর তাদের বুদ্ধিমত্তা কিংবা নির্বুদ্ধিতার কথা। তার মানে এই নয় এদের সবার সাথেই লেখকের পরিচয় আছে। লেখক অনেকটা দূর থেকে মানুষকে পর্যবেক্ষন করেন, খুব বেশি প্রয়োজন না হলে কাছে যান না, ছুঁয়ে দেন না। এই কথা মাথায় রেখে যারা গল্প, উপন্যাস বা প্রেমের কবিতা পড়তে পারবেন, সাহিত্য আসলে তাদের জন্যই।

কখনও লেখকের কাছে জানতে চাইবেন না, এসব ছাইপাশ লিখে কি হয়?

আপনার বোঝার জন্য লেখক সব লেখা লেখেন না। অনেকটা মনের আনন্দে যেমন সর্বশক্তিমান এই ব্রহ্মাণ্ড বানিয়েছেন, তার সবটাই আপনার বুঝতে হবে এমন কোন দিব্যি তিনি দেননি। তেমনি আপনার ছোট তেলাপকার মস্তিষ্ক নিয়ে সব লেখা আপনি বুঝে যাবেন সেরকম ভাবনা নিয়েও লেখক লেখেন না। কিছু আপনার পছন্দ হবে – কিছু হবে না। কে জানে… হয়তোবা সাহিত্যের রস আস্বাদনের মত জিহ্বা আপনার কস্মিনকালেও হবে না। কেন বৃথা চেষ্টা?

লিখতে গেলে প্রচুর পড়তে হয়, যে লেখকেরা অন্যের লেখা না পড়েই নিজে নিজে লেখা শুরু করেন তারা আসলে খুব বেশিদূর আগাতে পারেন না। আকাশ, বাতাস, পাখি, জ্যোৎস্না, আর তুমি আমি এই শব্দকটি থাকলেই কবিতা হয়না। কবিতা বাংলাদেশের সবাই লিখতে পারে, বইমেলায় দু-চারটে বইও বেরিয়ে যায় কোন চিপা-চাপা দিয়ে, কিন্তু সেটা কতটা মস্তিষ্কের খাদ্য আর কতটা গো-খাদ্য সেটা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা চলতে পারে। এক তরুন কবিকে হঠাই জিজ্ঞেস করেছিলাম বাংলা ভাষার বাদ দিয়ে আপনার প্রিয় কবি কে?

তিনি আমতা আমতা করে বলেছিলেন সেভাবে কারো কবিতা পড়া হয়না, তিনি ইংরেজীতে দূর্বল। তিনি বানিয়েও কারো নাম বলতে পারলেন না। আমি আবার জানতে চাইলাম তাহলে এদেশে প্রিয় কবি কে?

এবারও তিনি বললেন জীবনানন্দ বাদে আর কারো কবিতা তিনি পড়েননি। স্কুলে থাকতে পাঠ্যবইয়ে রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের কবিতা পড়েছেন।

আমি ঘোর সমস্যায় পড়লাম। এই লোক তার কবিতার বই বের করেছে, সে রবীন্দ্রনাথ আর নজরুল পড়েছে ইস্কুলে আর কোথাও থেকে হয়ত জীবনানন্দের একখানা বই উপহার পেয়েছিল এই জীবনে, তার কবিতা জ্ঞান এইটুকুই। শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে জীবনের যে দ্যোতনা, মূহুর্তের যে সংলাপ তার ছিটেফোঁটাও এর কবিতায় বা মননে নেই। সে কিনা ছাপার অক্ষরে কবি??!

সাহিত্য শুধু এলিট শ্রেনীর জন্য নয়, তা আপামর বুদ্ধিমান, সাহিত্য পিপাসু সাধারনের জন্য। আবার সাহিত্য বোকা গর্ধভের জন্যও নয়। কবিতার বই বের করলেই যেমন কবি হওয়া যায় না, ঘোমটা দিলেও তেমন লজ্জাবতী প্রমান হয়না।

পেটের টান থাকলে যে লেখা আমি লিখি সেটা সাহিত্য নয়। মনের আনন্দে আমি যা লিখি সেটাই সাহিত্য। এই আনন্দ খুঁজে পেতে আমাকে জলাঞ্জলি দিতে হয়েছে অনেক কিছু। আপনি বাবু কটা টাকা খরচ করে এলিট সাহিত্য বিশারদ হয়ে গেলেন? ক’খানা নোটের বদলে কাগুজে বই ছেপে এ-যুগের দস্তভয়স্কি সাজতে চান?

আপনার উদ্দেশ্য কিন্তু মনের আনন্দে লিখি ধরনের কিছু ছিলনা। লেখক হবার এই ভনিতার পেছনে আপনার মূল কারন বুদ্ধিবৃত্তিক সম্মান জোর করে কেনা। বেশ্যা অনেক টাকা উপার্জন করেও কিন্তু তার সতীত্ত্ব কিনতে পারবে না। আপনিও পারবেন না, এ অমোঘ সত্য।

কালে কালে অনেক বেলা হবে, সব কিছুই টাকা দিয়ে মাপার একটা চেষ্টা হবে। সামাজিক লেখক, বিজ্ঞাপন লেখক, চটি লেখক, সরকারদলীয় লেখক, বিরোধীদলীয় লেখক, সেলিব্রিটি লেখক ইত্যাদি নানা জাতীয় লেখকের মাঝে কখন বুঝবেন আপনিও লেখক?

যখন মনে হবে বলার মত একটা গল্প ছিল কিন্তু বলতে পারছি না, কি যেন একটা ভীষন ব্যাথা গোল পাকিয়ে আছে মস্তিষ্কের ঘুলঘুলিতে। কতগুলো অর্থহীন শব্দ পরপর বসে যাচ্ছে সাদা খাতায়। তুলির আরেকটা আঁচড় দেয়া বোধহয় বাকি রয়ে গেল ক্যানভাসে, আসি আসি করেও আসেনা ছন্দের ঝংকার – এই যে না বলতে পারার অব্যাক্ত বেদনা, এটা যখন আপনাকে কুরেকুরে খাবে, তখনি বুঝবেন আপনি লেখার জন্য প্রস্তুত। কাউকে দিয়ে তখন আর আপনার নিজের লেখা মাপতে হবে না।

লেখকের সবথেকে বড় জবানবন্দী কি জানেন?

জনতার মাঝে নির্জনতা। আশেপাশে সব কিছু রেখেও একজন লেখক সব সময় একটা নিঃসঙ্গতা অনুভব করেন। তার একান্ত আপন লেখাগুলো আসে সেই গোপন জায়গাটা থেকেই।

0 Comments

মন্তব্য

দেলোয়ার জাহান

মনের একান্তে কিছু কথা থাকে যা কাউকে বলা যায় না। বলতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খায় আমাকে। সে সকল হাবিজাবি জীবন দর্শন আর কিছু অসময়ের কাব্য নিয়ে আমার লেখালেখির ভুবন।

Pin It on Pinterest

Share This