যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম, মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করত সারারাত হাঁটব শহরের ওমাথা থেকে এমাথা পর্যন্ত। রাত যত গভীর হবে শহরের রূপ তত খোলে। কোন ব্যস্ততায় জানিনা সেটা আর হয়ে ওঠেনি। যখন হলে থাকতাম, আমি আর জহির মাঝে মাঝেই বের হয়ে যেতাম টিএসসির উদ্দেশ্যে। বিশেষ কোন কাজে নয় এমনিতেই। নানারকম জীবন দর্শনের কথা হোত জহিরের সাথে আমার। ক্লাসমেট বন্ধুদের মধ্যে মনে হয় জহিরই একটু আধটু আমাকে বোঝার চেষ্টা করত।
একসময় কিভাবে যেন তার একটা প্রেম হয়ে গেলো। বিকেলের পরে তাকে তখন বুয়েটে পাওয়া যেত। কখনও পলাশীতে বান্ধবীর সাথে চা খেতে আসলে আমাকে ডাক দিত। কিন্তু আমি স্পষ্ট বুঝতে পারতাম তার ইঞ্জিনিয়ার বান্ধবী আমাকে ঠিক পছন্দ করে না। একসময় আমিও যাওয়া ছেড়ে দিলাম। কি দরকার তৃতীয়জন হয়ে?
জহির স্কলারশীপ নিয়ে আমেরিকা চলে গেল। অ্যাপ্লাইড ফিজিক্সের জটিল গবেষণা নাকি আমেরিকার লোভনীয় জীবন কোনটা বেশি দরকার ছিলো বোঝা গেলো না। যাবার সময় দেখাও করে যায়নি। আমি তখন সদ্য পাশ করে একটা আর্ট ফার্মে আঁকিবুঁকি করি। খুব বেশি মন খারাপ করিনি। জীবন থেকে কত কিছুই চলে যায়।
তার বান্ধবী এরকম এক বৃষ্টির দিনে কেঁদেকেটে আমার ফার্মেগেটের বাসায় এসে উঠল। যে করেই হোক জহিরের ঠিকানা জোগাড় করে দিতে হবে তাকে। জহির নাকি আমেরিকা যাবার একমাস পরেই তার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। কোনভাবেই তাকে ট্রেস করা যাচ্ছে না।
যে হারিয়ে যেতে চায় তাকে খোঁজার মত নির্বুদ্ধিতা আর হয়না। কি নাম ছিলো যেন মেয়েটার… আদ্রিতা। কোনরকমে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে বিদায় দিতে হয়েছে। মা বেঁচে ছিলেন তখনও। বেশ একটা গন্ডগোলে পড়ে গিয়েছিলাম। সেই আদ্রিতারও নাকি এখন ছ-বছরের একটা বাচ্চা আছে। রসিয়ে রসিয়ে জহির একদিন বলেছিল আমাকে।
জহিরের দর্শনের মূলকথা, জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না- Life will always find a way । আদ্রিতা নাকি তার মোহ ছিলো প্রেম নয়। আমি এত কিছু বুঝতে চাইনি। এত গভীর প্রেম কিভাবে কেউ পায়ে ঠেলে দেয়? সেজন্য জহিরকে মাফ করবোনা ভেবেছিলাম। তারপর মনে হলো, আমি কে, তৃতীয়জন!
নাহ… মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। শহরজুড়ে এমন বৃষ্টি অথচ রাস্তায় কোন রোমান্টিক কাপল দেখতে পেলাম না। শহরটা ফ্লাইওভার আর ওভারব্রিজে ঢেকে যাচ্ছে। রাস্তায় কুৎসিত রকমের খোঁড়াখুঁড়ি। কয়েকটা আধা-ন্যাংটা ছেলে একটা চুপসানো ফুটবল নিয়ে কাদাপানির মধ্যে মনের আনন্দে লাথি মেরে যাচ্ছে। আনন্দ কত ছোট জিনিসেও আসে!
একটু জ্বর জ্বরও লাগছে। এর মাঝে বৃষ্টিতে হাঁটতে খারাপ লাগছে না। তিন পেগ ভডকা পেটে পড়লে যেরকম ঘোরের মধ্যে চলে যাই। সেরকম একটা অনুভূতি হচ্ছে। মন্দ না। মদ না খেয়েই মাতাল।
হাসপাতালে যে বাচ্চা চেহারার মেয়েটা আমাকে দেখে রাখত তাকে হাসপাতালে গিয়ে একটা চমক দিলে কেমন হয়? হটাত করে হালুম বলে তার ওয়ার্ডে ঢুকে গেলাম। নাহ… বাচ্চাদের মত হয়ে যাবে। এই পঁয়তাল্লিশের কেউ তার মেয়ের বয়সী কাউকে এভাবে চমকে দেয় না। অনেকদিন ওদিকে যাওয়া হয়না। শেষবার বলেছিল ঢাকা মেডিকেলে পোস্টিং হয়েছে। গ্রীনরোড থেকে ঢাকা মেডিকেল অনেক দূর। শরীর কুলাবে কিনা জানি না।
তবে মাঝে মাঝে নিজেকে কষ্ট দিতে ভালো লাগে। আর কয়েকটা দিন বেশি বেঁচে লাভ কি? মানুষই মনে হয় একমাত্র প্রানী যে নিজেকে কষ্ট দিয়ে একধরনের আনন্দ পায়। ডাক্তার বলেছে বাসায় গিয়ে রেস্ট নিতে। আরো বছর কয়েক বেঁচে থাকতে কোন সমস্যা হবার কথা না আমার। তবে নিয়ম করে চলতে হবে। মৃত্যুকে আমি মেনে নিয়েছি। রিনি আমাকে ছেড়ে চলে যাবার পর আর কোন কিছুতেই মন বসেনি। আচ্ছা ও কেমন আছে?
ওকেও একটা হালুম বলে চমকে দিলাম। ওর মায়ের বাসা গ্রীন রোডে। এখান থেকে হেঁটেই চলে যাওয়া যাবে। নাহ… এটাও করা যাবে না। আমার মেয়েটা চমকে যাবে। যে বাবাকে সে দেখেছে, ঘৃণা করতে শিখেছে, তাকে এভাবে দেখলে কিছুটা করুণা আর ভয় চলে আসবে। আমি কারো করুণা চাইনা।
বেশ লম্বা একটা জীবন পেয়েছি। পৃথিবীর আটটা দেশ ঘুরে দেখেছি। অনেকের ভাগ্যে তাও হয়না। রাজকন্যার মত একটা মেয়ে আছে। তার জন্য কিছু সঞ্চয়ও করে রেখেছি। আমি মরার পর ও যখন বড় হবে কোন কিছুতেই তার অভাব হবেনা। দুঃখ খালি একটাই রয়ে যাবে, রিনিকে বোঝানো গেলোনা।
যে চলে যেতে চায় তাকে ধরে রেখে লাভ নেই। মুক্ত পাখি নিজেকে যখন খাঁচায় বন্দি ভাবে তখন কোনভাবেই তাকে ধরে রাখা যায়না।
গুটিগুটি পায়ে তাই এই বৃষ্টির মধ্যেই আবার বাসায় ফিরে এলাম। জামাকাপড় না ছেড়েই বারান্দায় ইজিচেয়ারটায় আরাম করে বসে একটা সিগারেট ধরিয়েছি। বৃষ্টিটা এখন মনে হয় আরো বেড়েছে। কি অদ্ভুত, ঠান্ডা লাগার বদলে আমার কেমন যেন গরম লাগছে চোখেমুখে। হেলুসিনেশন হচ্ছে নাকি? গায়ে বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগছে কিন্তু সরতে ইচ্ছে করছেনা। যাক বারান্দার গাছগুলো কিছুটা পানি পাচ্ছে। শুকিয়ে সবকয়টা আমসত্ত্ব হয়ে গেছে। রিনি থাকলে নিয়মিত গাছগুলোর যত্ন নিতো। আমার এই শরীরে সেটা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এরা যে বছর খানেক ধরে টিকে আছে অবহেলায় এটাই বেশি।
আমি বেশ জোরে জোরেই বললাম- “হে বৃক্ষকুল তোমাদের কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আমার সাধ্য নেই তোমাদের টিকেয়ে রাখার। আমাকে ক্ষমা করে দিও।”
একবার মনে হোল মায়ের গলার আওয়াজ পেলাম। তা কি করে হয়? মা মারা গেছে বছর তিনেক হয়ে যায়। উনি আসবেন কোথা থেকে? হতেও পারে আবার… হ্যালুসিনেশন হলে মনে হয় অন্যজগতের মানুষের সাথে কথাবার্তা বলা যায়। সবাইতো আসলে আমাদের স্মৃতিরই একটা অংশ। প্রত্যেক মানুষের কাছে আমাদের আলাদা চেহারা আঁকা আছে।
বৃষ্টি আরো বেড়েছে। মনে হচ্ছে শহর ডুবিয়ে ছাড়বে আজকে। আমি ঘোরের মধ্যে উঠে গিয়ে কম্পিউটারে একটা গান ছেড়ে দিলাম। –
I walk a lonely road
The only one that I have ever known
Don’t know where it goes
But it’s home to me, and I walk alone…
বৃষ্টির সাথে মিলেমিশে একাকার। আহ… এখন বেশ আরাম লাগছে। এ সময় এক কাপ চা পেলে মন্দ হোত না। চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি আজকে। বেশ অনেকগুলো টাকা হাতে এসেছে। আবার বেরিয়ে পড়া যায়। যাবার আগে রিনিকে আর আমার রাজকন্যাকে একটা চিঠি লিখে চলে যাবো। কেমন হবে? অবাক হবে? রিনি কি আমার চিঠিটা দেবে রাজকন্যাকে?
আমি মনে মনে চিঠি লিখতে বসে গেলাম…
প্রিয় রাজকন্যা এলা,
তুমি কেমন আছো? বাবা বেশ ভাল আছি। তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু মা বলছে তিন মাস না হলে তোমার কাছে না যেতে। তাহলে আমাকে বকে দেবে?
তোমার বেড়ালটা ভালো আছে? ওকে কি স্কুলে নিয়ে যাও? সে কি আমাকে দেখলে এখনও চেঁচাবে? নাকি তুমি তাকে বলে দিয়েছ এটা আমার দুষ্ট বাবা। তার সাথে কথা না বলতে !
তোমার জন্মদিনে আসতে পারিনি। আমার দেয়া উপহার কি পেয়েছ? নানু কি তোমাকে জ্বালায় খুব।
বাবা খুব তাড়াতাড়ি তোমাকে দেখতে আসব।
ইতি তোমার
হালুম বাবা
কে যেন পাশে এককাপ চা রেখে গেছে নিঃশব্দে? আমি কিছু মনে না করেই তাতে চুমুক দিচ্ছি। এসময় কারো থাকার কথা না বাসায়। আমার স্পষ্ট মনে আছে বাসার দরজার লক খুলে আমি নিজেই ঢুকেছি। রান্না করে দেয়ার জন্য একটা বাঁধা বুয়া আছে, কিন্তু এই বৃষ্টিতে তার কোনভাবেই আসার কথা না।
আমার কি? চা পেয়েছি এটাই যথেষ্ট। যার খুশি সে বানিয়ে দিক। নাকি পুরোটাই আমার জ্বরগ্রস্ত মস্তিষ্কের কল্পনা। এই চাও নেই, চায়ের কাপটাও নেই। আমার পাশে বারান্দায় চেয়ারটাও নেই। জগত বড় রহস্যময়। সব কিছুই শুন্য থেকে আসে আবার শুন্যে মিলিয়ে যায়।
নাহ… বাসাটা এবার পাল্টাতেই হবে। অথবা রিনিকে চাবিটা দিয়ে বেরিয়ে যাবো। এখানে অনেক স্মৃতি জমে গেছে। বড্ড জ্বালাচ্ছে।
কিন্তু ভাঙ্গা সংসারে রিনি ফিরবে না। আমি চলে গেলে হয়ত মেয়েকে নিয়ে আবার ফিরে আসবে এখানে। নিজের বলে মাথা গোজার একটা ঠাঁইতো আছে ওদের এই প্রাচীন শহরে। পাখিরাও সন্ধ্যা হলে নিজের বাসায় ফিরে যায়।
বড্ড ঘুম পাচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ ঠান্ডা আঙুল বুলিয়ে দিচ্ছে আমার চুলে।
—
0 Comments