বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর

May 19, 2023গল্প, সাহিত্য0 comments

‘নাম এবং প্লানেট অব অরিজিন বলুন’ – সারিন সামনে দাঁড়ানো দোপেয়ে জানোয়ারটিকে বলে। গ্যালাক্সির এই দিকটায় এদের খুব একটা দেখা যায় না। তার উপর হাতে একটা নীল রঙের ডিএনএ পাস কার্ড, এটাতো আরো অবিশ্বাস্য। নিশ্চই ব্যাটা অন্য কারোটা মেরে দিয়েছে।

‘নীল… মানে ব্লু, আবার আকাশী নীল ভেবো না। আমার নীল গাঢ় নীল।‘ দোপেয়ে হাসিমুখে জবাব দেয়। 

‘বেশী কথা বলাটা তোমাদের প্রজাতির স্বভাব। এইখানে কি করতে এসেছ? আমার জানামতে গ্যালক্সির এই দিকটায় কোন মাইনিং অপারেশন চলে না।’ সারিন বিরক্ত হয়ে বলে। সে ধরেই নিয়েছে ব্যাটা নিশ্চই কোন ধান্দাবাজ।

‘সাধে কি আর আসি। আমাকে পাঠানো হয়েছে গ্যালাকটিক কাউন্সিল থেকে। এই জায়গাটা একদম ভালো না। সবাই কেমন গোমড়া মুখে বসে থাকে।’

সারিন কিছুটা অবিশ্বাসে তাঁকিয়ে থাকে। এই দোপেয়ে হোমো স্যাপিয়েন্সকে গ্যালাকটিক কাউন্সিল পাঠিয়েছে! তার আট হাতের একটা বাড়িয়ে সে নীল রঙের ডিএনএ পাস কার্ডটি নিল। সামনের রাখা মনিটরের সাথে স্ক্যান করে মিলিয়ে নিচ্ছে।

“নীল আহমেদ, অরিজিন ভেনাস আউটার রিম হিউম্যান কলোনি।… আইডি – MPS-0001224।” সারিনের সংশয় তাও দূর হয়না। 

“কি কারনে তোমাকে পাঠানো হয়েছে?’

‘সেটাতো তোমাকে বলা যাবে না – অক্টু!’ – নীল হাসে।

অক্টু মানে…?  সারিনকে কিছুটা বিব্রত মনে হয়। ‘আমার নেমপ্লেট দেখো, আমার নাম সারিন।’

‘জানি, তবে তুমি দেখতে আমাদের পৃথিবীর একটা প্রানী অক্টোপাসের মত। ওরাও তোমার মত আটটা হাত ব্যবহার করত।’ নীল আবার একটা হাসি উপহার দেয় সারিনকে।

‘ওরা কি আমার মত ইন্টার গ্যালাকটিক ট্রাভেল আর কোয়ান্টাম কম্পিউটার নিয়ে কাজ করত?’

‘না, অক্টোপাসেরা সেই পর্যায়ে যায়নি। তার আগেই মানুষের ইভোলিউশন পুরো গ্রহটাকে বরবাদ করে দিয়েছে।’ নীল দুঃখী গলায় বলে। ‘সেই সাথে অক্টোপাসেরাও হারিয়ে গেছে, নষ্ট হয়ে গেছে আমাদের সমুদ্র।’

তারমানে, তোমার প্রজাতি আগে থেকেই বোকা – নতুন কিছু নয়।

বোকা বলছ কেন? বরং অতি উতসাহী বলতে পারো। আমার জন্ম ভেনাসের আউটার রিমে, তারমানে আমরা কত দূর যেতে পেরেছিলাম, সেটা ভেবে দেখেছ!

‘তা আর বলতে…।’ সারিন টিপ্পন্নি কাটে। ‘গ্যালাকটিক কাউন্সিল না থাকলে এতদিনে না খেয়ে মরতে।’

নীল জবাব দেয় না। কখনো না দেখা পৃথিবী নামক গ্রহটার জন্য একটা আদিম টান অনুভব করে। তার সামনে বসা এই বর্ডার গার্ডকে হঠাৎ করে তার বিরক্ত লাগছে। হতে পারে মানুষ বোকা ছিল, কিন্তু এখনতো আর নেই।

এই গ্যালাক্সির মাইনিং অপারেশন গুলোতে মানুষেরাই সবথেকে বেশি পরিশ্রম করে। সবার চেয়ে বেশি ঝুঁকি নেয়। টাইম ট্রাভেলের লুপ হোল মানুষেরাই আবিষ্কার করেছে। সংগীতে কেউ এখনও মানুষের সমকক্ষ নয়। সামনের কয়েক হাজার বছরে আরো কত কিছু মানুষের দেবার আছে গ্যালাক্সিকে, কে জানে!

‘সব ঠিক আছে? আমার পাস দাও!’ নীল কিছুটা অধৈর্য হয়ে বলে। তবে সে রাগতে চায় না। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এই নীল পাস যোগাড় করা গেছে।

দিচ্ছি, কিন্তু আমি বুঝতে পারিনা, এত এত স্পেসিস থাকতে তোমাকে কেন পৃথিবী দেখতে পাঠানো হচ্ছে?

নীল চমকে ওঠে, এই অক্টো কি করে জানল সেটা? সে তো বলেনি।

‘অক্টোরা ট্যালিপ্যাথিক… তোমার কি মনে হয়, আমরা যদি অন্য প্রানীর মনের কথা বুঝতেই না পারি তবে এই বর্ডার অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করব কিভাবে?’ সারিন হাসির মত ভঙ্গি করে। যদিও নীল বুঝতে পারে না। এই অক্টোদের চেহারা সবসময়ই গম্ভীর।

তারমানে আমি যা ভাবছি সব তুমি জানো?

সব না। যদি তোমার কোন চিন্তা অনেক বেশি বিদ্যুৎ প্রবাহ শুরু করে মস্তিষ্কে তবেই সেটা বুঝতে পারি। সবাই ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা করে, সেটাও একটা সমস্যা। এগুলো অনুবাদ করাটাও কঠিন।

“এই যেমন তুমি এখন ভাবছ, বৃষ্টিতে একটা মেয়ের হাত ধরে হাঁটবে…। এর কিছুই আমি বুঝতে পারছি না।” সারিন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাঁকায় নীল এর দিকে।

নীল কিছুটা লজ্জা পায়।

বৃষ্টি আমিও কোনদিন দেখিনি। আমাদের স্কুলের কম্পিউটার আর্কাইভে পৃথিবীর কিছু ফুটেজ ছিল, সেখানে দেখেছি। বিষয়টা নাকি দারুন রোমান্টিক। আর যে মেয়েটের কথা ভাবছিলাম সে আমার প্রেমিকা।

‘খ্রোত…।’ নাক বিহীন মাথা থেকে একটা অদ্ভুত শব্দ বের হয় সারিনের। ‘কি জানি…অদ্ভুত প্রজাতি তোমরা। যুক্তির থেকে আবেগে বেশি চলো।’

নীল হাসে। ‘আমাকে অনুমতি দাও। তোমার সাথে বেশিক্ষন থাকলে তুমি আমার মনের সব কথা জেনে যাবে।’

সেটাই দরকার। নিরাপত্তা সবার আগে।

কিন্তু কাউন্সিল আমাকে অনুমতি দিয়েছে যাবার।

সেটা দিতেই পারে। কিন্তু আমাকে জানতে হয় কে, কোথায়, কেন যাচ্ছে? গ্যালাকটিক হাইওয়ে কোন ছেলেখেলা নয়। বিশেষ করে একা একা যখন তৃতীয় শ্রেনীর কাতারে পড়ে এরকম প্রজাতির কেউ ভ্রমন করে।

তো…! আমাকে পারমিশন দেবে না?

আমি কি একবারও সেটা বলেছি? তুমি আমার প্রশ্নের জবাব দাও তাহলেই হবে।

বেশ… কি জানতে চাও?

তোমার পূর্ব পুরুষেরা কোথা থেকে এসেছিল? সারিন চোখ বড় বড় করে তাঁকায়। যদিও তার চোখে বেশ অনেকগুলো মানুষের মত দুটো নয়। সে নীলের মাথার ভেতরে ভয়ংকর কিছু আছে কিনা সেটাই দেখতে চাইছে।

আমি যতদুর জানি, পৃথিবীতে ইন্ডিয়ান ওশেনের কাছাকাছি কোন একটা জায়গা থেকে।

ফিরে গিয়ে কি দেখতে চাও, পৃথিবীতে?

সেটা বলা যাবে না।

হুম…। ঠিকাছে যাও। সারিন তার হাতের কার্ডটি ফিরিয়ে দেয় নীলকে।

নীল কিছুটা অবাক হয়। এত জলদি ছেড়ে দেবে সে ভাবেনি। মানুষ দেখলেই সবাই কেমন যেন দূরদূর করে আর সন্দেহের চোখে তাঁকায়। আর হাতে যদি নীল রঙের ডিএনএ কার্ড থাকে তবে সেটা আরও একশগুন বেড়ে যায়। হাজার হোক মানুষ হচ্ছে কামলা শ্রেনীর।

ওদিকে সারিন তখন ভাবার চেষ্টা করছে, এই দোপেয়ের মাথায় যে ছড়াটা ঘুরছিল সেটা আসলে কি? এরকম ছন্দ কেন, কোনভাবেই ভোলা যাচ্ছে না…। অদ্ভুত…।

বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর
নদে এলো বান,
শিব ঠাকুরের বিয়ে হবে
তিন কন্যা দান।
এক কন্যা রাধেন বাড়েন
এক কন্যায় খান,
আরেক কন্যা না খেয়ে
বাপের বাড়ি যান।

বৃষ্টি না হয় বোঝা গেল… কিন্তু টাপুর টুপুর আবার কি জিনিস? কে এই শিব ঠাকুর? আর কন্যারা কেন রাঁধেন? রান্নাটা আসলে কি? নাহ একবার গ্যালাকটিক লাইব্রেরীতে দেখতেই হচ্ছে। বুঝতে না পারলে ব্যাপারটা মাথা থেকে নামানো যাচ্ছে না। বড় গোলমেলে প্রজাতি।

ওদিকে নীল লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। ভয় পাচ্ছে আবার না পেছন থেকে ডেকে বসে অক্টোটা। পেছনে ফিরে দেখল অক্টো অদ্ভুত ভাবে মাথা নাড়াচ্ছে আর প্রবল গতিতে হাতের মত তার চারটা শুড় সামনের প্যানেলে বাড়ি দিচ্ছে। নীল কিছু বুঝতে না পারলেও, আন্দাজ করল এখান থেকে দ্রুত কেটে পড়াই ভালো।

0 Comments

মন্তব্য

দেলোয়ার জাহান

মনের একান্তে কিছু কথা থাকে যা কাউকে বলা যায় না। বলতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খায় আমাকে। সে সকল হাবিজাবি জীবন দর্শন আর কিছু অসময়ের কাব্য নিয়ে আমার লেখালেখির ভুবন।

Pin It on Pinterest

Share This