|| এক ||
ঘাটে থাকতেই লোকটা আমার পিছু নিয়েছে। প্রথমে বুঝতে পারিনি। কিন্তু তার ঐ ক্যাটক্যাটা হলুদ রঙের গেঞ্জি আর ড্যাব ড্যাব করে আমার দিকে বারবার তাঁকিয়ে থাকা একটু পরেই অস্বস্তির কারন হয়ে দাঁড়াল।
তার উপর ইয়া বড় কালো রঙের একটা ডাফেল ব্যাগ তার কাছে। এত বড় ডাফেল ব্যাগ সাধারনত খেলোয়াড়রা ব্যবহার করে। লঞ্চে যাতায়তের জন্য এই বড় ডাফেল ব্যাগ আমি এর আগে কাউকে ব্যবহার করতে দেখিনি। সুটকেস, কাঁধের ঝোলা, ট্রাভেল ব্যাগ সবই থাকে লোকজনের কাছে কিন্তু এই ঢাউস সাইজের ডাফেল ব্যাগ কারো কাছে নেই।
মেজাজটাও কিঞ্ছিত খারাপ আমার। সদরঘাটে পৌছেই বুঝেছিলাম লঞ্চ মিস করব, হয়েছেও তাই। ইচলিতে করে চাঁদপুর বোনের বাসায় যাবার কথা ছিল। এখন ভাঙ্গাচোরা একটা লঞ্চে উঠেছি, মধুমতি বা অন্য কিছু হবে বোধহয়। এখানেও গাদাগাদি ভিড়, ধাক্কাধাক্কি করে যে উঠতে পেরেছি এটাই ভাগ্য। কোন নিরাপত্তার বালাই নেই। এত মানুষ কোথা থেকে আসে?
আমি আড়ঁচোখে দেখে নিলাম হলুদ গেঞ্জি কোথায়। রেলিং এর সাথে ব্যাগ রেখে উদাস ভাবে বুড়িগঙ্গার কালো পানির দিকে তাঁকিয়ে আছে। কি হতে পারে? পকেট্মার, চোর, বাটপার…?
আমার সাথে দামি কিছু নাই একটা ফোন বাদে। আর ঘাট থেকেই একে আমার পিছু পিছু দেখছি, সবসময় কাছাকাছি থাকছে, এই লঞ্চেই উঠতে হবে ব্যাটার? নাকি আমার মতই অবস্থা? শেষ সময়ের যাত্রী!
একটা সিগারেট পেলে মন্দ হোত না, এত ভিড় ঠেলে সামনে দোকানের দিকে যাওয়ায় কষ্ট। আমি এদিক ওদিক তাঁকাচ্ছি।
ঃ সিগারেট খাবেন?
আমি আচমকা আঁতকে উঠলাম এই কথায়। হলুদ গেঞ্জির ডাফেল ব্যাগ আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে ধরা গোল্ডলিফের প্যাকেট, আমাকে সাধছে।
ঃ সিগারেট খুঁজছি আপনাকে কে বলল? আমি চমক সামলে কিছুটা রুঢ় গলায় বললাম।
ঃ যে ধাক্কাধাক্কি করে উঠেছি আর আপনার এদিক ওদিক তাঁকানো দেখে ধরেই নিসি আপনি সিগারেট খুঁজছেন। আমি সদরঘাটে আপনার সাথে একই বাসে এসেছিলাম, আপনি মনে হয় খেয়াল করেননি।
ওহ… তাহলে এই ব্যাপার! এ কারনেই সে বারবার আমার দিকে তাঁকাচ্ছিল। আলাপ জমানোর চেষ্টায় ছিল। এখন সুযোগ বুঝেই সিগারেট সাধছে।
ঃ নাহ… আমি গোল্ডলিফ খাই না।
ঃ তাইলে থাক…। বলেই একটা বের করে নিজেই ধরাল। নিচের ডেকে সিগারেট খাওয়া নিয়ে কারো কোন মাথাব্যাথা নেই। হলুদ গেঞ্জির সিগারেটের ধোয়ায় আমার নেশাটা আরো মাথা চাড়া দিয়ে উঠল।
লঞ্চ সদরঘাট ছেড়েছে অনেক্ষন কোলাহল আস্তে আস্তে কমে এসেছে। আমি কিছুটা অসহিষ্ণু হয়েই বললামঃ –
ঃ দেন… আপনার হাতেরটাই দেন, দুই টান মারি।
হলুদ গেঞ্জি হাসল, তারপর হাতের সিগারেট আমার দিকে বাড়িয়ে ধরল।
ঃ ভাইজান মনে হয় অপরিচিত লোকজনরে ঠিক বিশ্বাস করেন না।
ঃ কে বলল করি না, এই যে আপনার আধ-খাওয়া সিগারেট খাচ্ছি, বন্ধু-বান্ধব বাদে কেউ সিগারেট শেয়ার করে খায় দেখছেন?
“তা অবশ্যি ঠিক” হলুদ গেঞ্জি মাথা নাড়ে। আমি কিছু বলি না। জঙ্গলের নিয়ম হচ্ছে পশুপাখি যেখান থেকে খায় সেখানে থেকে পানি খেতে হয়, তাতে বিষক্রিয়া হবার সম্ভাবনা নাই। সবথেকে ভালো হয় পানি না খেয়ে বেঁচে থাকতে পারলে। কিন্তু সেটা সম্ভব না।
ঃ চানপুরে আপনার বাসা কই?
ঃ সদরেই…। আমি কিছুটা নিরাসক্ত ভাবে বলি। ধোয়া উপরে পাঠিয়ে একটা রিং বানানোর ব্যার্থ চেষ্টা করি। আড়চোখে দেখলাম লোকটা প্যাকেট থেকে আরেকটা সিগারেট বের করে ধরিয়েছে। আমি দেখেও না দেখার ভান করি। বাঙালীর স্বভাব পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেই অযথা ব্যক্তিগত ব্যপারে খবর নেয়া শুরু করে। এখন আর অবাক হই না। আপনি কালচার সহজে পরিবর্তন করতে পারবেন না।
ঃ সদরে কই…? আমি থাকি গুয়াখোলা। হলুদ গেঞ্জির উতসাহে কমতি নাই।
ঃ আপনার ব্যাগে কি, এত বড় ব্যাগ নিয়ে লঞ্চে উঠলেন কেমনে?
ঃ ব্যাগে… নাহ কি থাকব? জামাকাপড় আর কিছু শুকনা খাবার। – লোকটা খানিকটা তোতলায়। তার অস্বস্তি আমার নজর এড়ায় না। যাক, কাউন্টার কোশ্চেন করাতে তার গল্প করার শখ কিছুটা কমলেও ভালো। ডেকে বসার জায়গা নাই, আজকে এত লোক।
লোকটা ব্যাগটা ঠেলেঠুলে একটু জায়গা করে নিল একটা কোনায়। এত বড় ব্যাগ সবাই বিরক্তির চোখে দেখছে।
ঃ ভাইজান আসেন বসেন। দাঁড়ায়া থাকতে থাকতে পায়ে খিল ধরে গেছে। বলেই ধপাস করে ব্যাগের উপর বসে পড়ল। সুযোগের অপব্যবহার না করে আমিও তার পাশে এই ঢাউস ডাফেল ব্যাগের উপর বসে পড়লাম। আসলেই মনে হয় কাপড় চোপড় আছে। নরম গদির মত লাগল আমার কাছে।
ঃ আপনার ব্যাগের যেই সাইজ, এটার ভিতর ঘুমাইয়া থাকা যাবে।
ঃ তা যাবে, তবে এই ব্যাগের একটা ইতিহাস আছে। আপনে চাইলে আপনারে বলতে পারি।
আমি নিরানন্দ গলায় বললাম “বলেন”। করার মত আর কিছু নেইও এই ভিড়ের মাঝে। শুধু শুধু বসে না থেকে এর গল্প শোনা যাক। লোকটাকে এখন আর ততটা খারাপ লাগছে না।
ঃ এই ব্যাগ আমার না, দিসে আরেকজন। তার সাথে আমার চট্টগ্রামে দেখা হইসিল, সালেহীন নাম। সেইবার ট্রেনে পরিচয় হবার পর সে আমারে এই ব্যাগটা দেয়। এটা একটা স্পেশাল ব্যাগ।
ঃ কি স্পেশাল?
লোকটা কিছুটা গলা নামিয়ে বলল, “এই ব্যাগের ভিতর একটা গোপন সুড়ং আছে। ব্যাগের চেইন খুইলা আপনি যেখানে যাইতে চান মনে মনে চিন্তা করলেই সেখানে পৌঁছে যাবেন।
আমি অনেক কষ্টে হাসি আটকে রাখার চেষ্টা করে সিরিয়াস গলায় বললাম-
ঃ আপনে তাইলে ঠেলাঠেলি কইরা লঞ্চে উঠলেন কেন? ব্যাগে ঢুইকাই তো চাঁনপুর চইলা যাইতে পারতেন।
ঃ ভাইজান, এমনে না… চাইলেই হবে না। সঠিক প্রয়োজনে চাইতে হবে আর জীবনে একবারই একজন মানুষ ব্যবহার করতে পারে। আমার ব্যবহার শেষ। এখন এটা অন্য কাউরে দিয়া দিতে হবে।
ঃ মানে… আপনে এইডা ব্যবহার করছেন?
লোকটা মিটিমিটি হাঁসে। চোখে তৃপ্তির একটা ঝিলিক। আমি কিছুটা বিরক্ত হই। গাঁজা খেয়েও কেউ আজকাল এই ধরনের ফ্যান্টাসি গল্প দেবে না। আর কোন এঙ্গেল থেকে দেখে এই লোকটার মনে হল আমি এই ধরনের গল্পে বিশ্বাস করব? শুধু একটা সিগারেট নিয়েছি দেখে ভদ্রতা করে কিছু বলছি না।
ঃ করসিলাম একবারই, তারপর আর কাজ করে না।
ঃ কবে করেছেন? আমি নিরাসক্ত গলায় বললাম।
ঃ আমার প্রথম বাচ্চাটা যখন হয়। আমি তখন ঢাকায় বউ চানপুরে। লোকটা কিছুটা গলা নামিয়ে বলে। “ও ভাইজানের তো নামই জিজ্ঞেস করা হয় নাই।”
ঃ আমি রাসেল। আপনের নাম কি?
ঃ শাহরিয়ার হোসেন…। ভাইজান মনে হয় আমার কথায় বিশ্বাস করেন নাই। আমিও যখন এই ব্যাগের কেরামতির কথা প্রথম শুনি তখন আপনার মতই বলসিলাম সালেহীন সাহেবরে…। তিনি অবশ্য কিছু মনে করেন নাই। আমারে খালি ব্যাগটা ধরাইয়া দিয়া বলসিলেন, “ফ্রিতে দিতাসি নিয়া যাও, কামে লাগলে লাগব না লাগলে নাই। তোমারতো কোন ক্ষতি নাই।”
ঃ আপনে আসলে কি করেন শাহরিয়ার ভাই? আপনার কথা শুনেতো সাধারন ক্যানভাসারের মত মনে হয় না। ঐযে যারা লঞ্চে, বাসে তেল আর মলম বিক্রি করে।
লোকটা হাসে। আমার খোঁচামারা কথায় কান দেয় না।
ঃ আমি একটা গার্মেন্টসে মার্চেন্ডাইজার।
ঃ ভালো…। কিন্তু আপনার গল্পটা যে গাঁজাখুরি সেটা বুঝতে পারসেন।
ঃ না… মিথ্যা বলতেসি না। বললাম না… আমার প্রথম বাচ্চাটা হওয়ার সময় আমি ঢাকায় ছিলাম, লকডাউনে আসার আর কোন রাস্তা না পাইয়া এই ব্যাগের সাহায্যেই চাঁনপুর আসি। সিস্টেম সোজা… চেইন খুলবেন আর মনে মনে চাইবেন যেখানে যেতে চান।
আমার ভ্রু কুঁচকানো দেখে শাহরিয়ার থামে…।
ঃ আসেন চেইন খুলে দেখি কি আছে ব্যাগে। … প্রমান দেন।
ঃ রাসেল ভাইজান… প্রমান চাচ্ছেন মানে আমার কথা আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না। অথচ এই ব্যাগ কাজই করে বিশ্বাসের উপর।
ঃ বিজ্ঞানে বিশ্বাস বলে কিছু নাই। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র। এক বিজ্ঞানী আরেক বিজ্ঞানীর কথাতেই বিশ্বাস করে না, আর আপনে বলতেসেন একটা ব্যাগের ভিতর স্পেস টানেলের কথা!
ঃ সেটা … আবার কি জিনিস? আমি খালি বলতেসি এই ব্যাগটা আমারে একবার ঢাকা থেকে চাঁনপুর নিয়া আসছিল। কিভাবে গেসিলাম আমি জানি না।
শাহরিয়ারের সরল স্বীকারোক্তিতে আমি কিছুটা অবাক হই। এই ভীড়ের মাঝেও আমার মনে হয় লোকটা সত্যি কথা বলছে। তার চকচক করে ওঠা চোখ আর সরল গলার স্বর, কি জানি… আমি একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম। এরকম একটা কিছু থাকলে মন্দ হোত না। মানুষ টাইম ট্রাভেল করতে না পারুক অন্তত একটা নির্দিষ্ট জায়গায় ভ্রমনের সুবিধা পেত। কিন্তু পদার্থ বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমি জানি এটা কতটা অলীক ধারনা…!
ঃ শাহরিয়ার ভাই আরেকটা সিগারেট দেন। আপনার ব্যাগের থিওরি একটু ধোঁয়া মেরে দেখি। এইটা যদি এই পৃথিবীতে সম্ভব হয়ে থাকে তবে পদার্থ বিজ্ঞানের কোন কোন সূত্র তাকে ভাঙ্গতে হবে!
ঃ এই নেন… শাহরিয়ার আমার দিকে আরেকটা সিগারেট বাড়িয়ে ধরে। … রাসেল ভাই… আমি ব্যবসা বুঝি, বিজ্ঞান অতটা বুঝি না। আপনি হয়ত আমার থেকে বেশি পড়াশোনা করছেন, তবে আমি যেটা বলেছি আপনাকে সেটা গাঁজাখুরি কিছু না। একটা ছোট্ট প্রমান আপনারে দিতে পারি। আপনি মনে কইরেন না আবার ম্যাজিক।
ঃ কি প্রমান…? আমি কিছুটা আগ্রহী হই এবার।
ঃ বলেন আপনে কি খাইতে সবথেকে বেশি পছন্দ করেন। ছোটখাট জিনিসের কথা বইলেন। এই ভীড়ের মাঝখানে বড় জিনিস আনলে মানুষের নজরে পড়ে যাব। শারিয়ারের গলা আরো খাদে নেমে যায়।
ঃ আপাতত, এক প্যাকেট মালবোরো এডভান্স সিগারেট পেলে মন্দ হোত না। আমি একগাল ধুঁয়া উপর দিকে পাঠিয়ে বলি।
ঃ নাহ… এরকম কিছু না। এমন একটা কিছু যেটা আপনার বাসায় আছে, সিগারেট আনলে আপনি মনে করবেন আমি হাত সাফাই দেখাইতেসি।
ঃ অহ… আমি এবার শাহরিয়ারের বুদ্ধিমত্তায় চমৎকৃত হই। লোকটা নিশ্চই ব্যাগ থেকে এমন একটা কিছু বের করে আমাকে দেখাতে চাইছে যাতে আমি তার ব্যাগ থিওরি বিশ্বাস করতে বাধ্য হই। সিগারেট আনলে সেটাকে সহজেই ব্যখ্যা করা যায়। শেষ পর্যন্ত কি সে আমার কাছে ব্যাগ বিক্রি করতে চায়? এই বয়সে বাটপারের খপ্পরে পড়ার কোন ইচ্ছা নাই আমার। যতই ইনোসেন্ট আর সরল সোজা লাগুক এই শাহরিয়ারকে।
ঃ হুমম … আচার খাইতে ইচ্ছা করে… আমার টেবিলের উপর রাখা আছে… ঢাকার বাসায়… আনতে পারবেন?
ঃ সরেন দেখি আসে নাকি… আমাকে এক প্রকার জোর করেই ব্যাগের উপর থেকে একটু সরিয়ে পাশের সাইড পকেটের চেইন খুলে হাত ঢুকিয়ে দিল শাহরিয়ার। এবং আমার দিব্যদৃষ্টিতে আমি দেখতে পেলাম তার হাতে শোভা পাচ্ছে আমার আধখাওয়া বোতলের আঁচার। কেন… কিভাবে… বোঝার আগেই আবার হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে শাহরিয়ার এবার তার হাতে আমার অতি পরিচিত লাইটার আর টেবিলের উপর রেখে আসা সিগারেটের প্যাকেট।
আমি চট করে দাঁড়িয়ে গেলাম। হঠায় করে কয়েক সেকেন্ডের জন্য মনে হল একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছি। আশেপাশে এত মানুষ যে যার যার গল্পে মশগুল… কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমি আর শাহরিয়ার একাই এই লঞ্চে। একটা শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে আমার মেরদন্ড দিয়ে।
স্বভাব সুলভ সরল একটা হাসি দিয়ে শাহরিয়ার আমার দিকে লাইটার আর সিগারেট বাড়িয়ে দিল।
ঃ আর হবে না, কানেকশন ছুটে গেছে। আপনি যতক্ষন ব্যাগের উপর বসে ছিলেন ততক্ষন আপনার জিনিসপত্র ব্যাগের নাগালে থাকে।
আমি অবাক হইনি এমন ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে লাইটার আর সিগারেটের প্যাকেট হাতে নিলাম।
।।দুই।।
রাত বাড়ছে ডেকের যাত্রীরা জায়গা করে নিয়ে শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমি তখন রেলিং এ হেলান দিয়ে আমার পাঁচ নম্বর সিগারেটটা ধরিয়েছি। কোথা থেকে কি হয়েছে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। নিজের সিগারেট লাইটার আর আঁচারের বোতল কোনভাবেই আমার না চিনতে পারার কথা নয়।
কিন্তু ব্যাপ্যারটা কি হল? কোন ভাবেই আমি মেনে নিতে পারছি না। এটা ম্যাজিক বলেও মনকে প্রবোধ দিতে পারছি না। শাহরিয়ার এখনো একজায়গায় বসে আছে। আমার চেহারায় সন্দেহ দেখে কাছে আসার চেষ্টা করছে না। তবে কেমন যেন একটা দুঃখী দুঃখী চেহারা করে রেখেছে।
আমি নিজেই হেঁটে গিয়ে তার কাছে দাঁড়ালাম –
ঃ শাহরিয়ার ভাই…জিনিসটা কিভাবে করলেন বলবেন? রাতে ঘুম আসবে না আমার না জানতে পারলে।
ঃ ভাই, আপনাকে ব্যাগের কথা পুরোটাই বলেছি, তারপরেও আপনি সন্দেহ করছেন। …… শাহরিয়ার কিছুটা দম নেয়… সত্যির থেকে মিথ্যা অনেক বেশি সহজ বলেই মানুষ মিথ্যা কথা শুনতে আর বলতে পছন্দ করে।
আমি দ্বিমত করলাম না, কিন্তু এই প্রমান সাইজের ঢাউস ব্যাগের কথাও আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। তবে মনে হয় না শাহরিয়ার এর বাইরে আমাকে কোন ব্যাখ্যা দেবে। স্পেস টাইম বেন্ডিং প্রযুক্তি মানুষের নাগালের বাইরে। এই আপাত দেখতে ডাফেল ব্যাগ একটা বিস্ময়কর জিনিস এটা আমি কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছি না।
আমি হতাশ হয়ে আবার রেলিঙের কাছে ফেরত গেলাম। বাইরে অন্ধকারে কিছু দেখাও যাচ্ছে না। লঞ্চের সামনের বাতিটা এই সময় নিভে গেল, এটা বিপদজনক। রাতের বেলায় আলো বাদে নদীতে লঞ্চ অন্ধ। সামনের দিক থেকে চিল্লাচিল্লি আর হট্টগোলের আওয়াজ আসছে।
আমি রেলিং থেকে সরে দাঁড়ালাম, আজকে সারা দিনই কুফা যাচ্ছে। এমনিতেই রাতের বেলা লঞ্চ আস্তে চালানো হয়, তারপর বাতি নিভে গেলে লঞ্চ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকবে।
এবং… আমাকে হতবিহব্বল করে দিয়ে লঞ্চ কিছু একটার সাথে ধাক্কা খেল। ধাতব ঘষার আওয়াজ, কিছু মানুষের আর্ত-চিতকার, আমার নিয়ন্ত্রন হারিয়ে মেঝেতে পড়ে যাওয়া… সব কিছু এত দ্রুত ঘটে গেল আমার মাথা থেকে শাহরিয়ার আর তার ব্যাগের কথা বেমালুম উবে গেল। বেঁচে থাকার আদিম ইচ্ছায় আমি কিছু একটা খুঁজে পাবার আশায় হাঁটুগেড়ে এদিক সেদিক তাঁকাচ্ছি।
লোকজনের বিশাল চেঁচামেচির মাঝেও এটুকু বুঝতে পারলাম, লঞ্চ ডুবছে… কেন… কিভাবে সে সবের সময় নাই। সবাই বাঁচার চেষ্টায় উপরের দিকে যাবার চেষ্টা করছে।
আমি নিতান্তই অসহায়… সাঁতার জানি না। একটা বয়া বা অন্য কিছু পেলে ভেসে থাকার চেষ্টা করতে পারতাম। এভাবে মারা যেতে হবে ভাবিনি। আমার খুব মায়ের চেহারা আর ছোট বোনটার কথা মনে পড়ছে। কালকে সকালে আমার লাশ খুঁজে পাবে কিনা সন্দেহ।
মৃত্যু নিশ্চিত জেনে নিজেকে কেমন যেন নির্ভার আর নিস্তরঙ্গ মনে হচ্ছে। বিপদে পড়লে শেষ চেষ্টাটাও মানুষ করে দেখে। আমার চোখ এই অন্ধকারে কিছুই দেখছে না। বাকি সব বয়া ইতিমধ্যে অন্যরা দখলে নিয়ে নিয়েছে।
এই সময় কে যেন আমার হাত ধরে টানল… শাহরিয়ার… তার হাতে সেই ম্যাজিক ডাফেল ব্যাগ শক্ত করে ধরে আছে সাত রাজার ধনের মত।
ঃ ভাই লঞ্চ ডুবে যাচ্ছে… আমি সাঁতার জানি না… বাঁচার কোন উপায় নাই… আমার গলার কান্নার আওয়াজ।
শাহরিয়ার হাসে… রাসেল ভাই… ডরায়েন না… আমি আছি… আমারে শক্ত করে ধরেন। আপনার হাতটা দেন দেখি।
অন্ধকার সয়ে গেছে চোখে এতক্ষনে। শাহরিয়ারে হাসি দেখা না গেলেও আমি পরম নির্ভরতা খুঁজে পাচ্ছি তার কথায়। আমি ডান হাত বাড়িয়ে দিলাম। শাহরিয়ার তার ডাফেল ব্যাগের চেইন খুলছে… আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার হাত কনুই পর্যন্ত একটানে সে ঢুকিয়ে দিল ব্যাগের ভেতরে।
মনে হল কেউ একজন আমার হাত ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে উপরে তুলে ফেলল। এরপর চারিদিক অন্ধকার আর আমি শুন্য থেকে পড়ছি তো পড়ছি… আর কিছু নেই কোথাও… জ্ঞান হারালাম।
।। তিন।।
জ্ঞান ফিরে পেয়ে নিজেকে আবিষ্কার করলাম একটা চায়ের দোকানে। জনা কয়েক অপরিচিত মুখ আমার উপর ঝুঁকে আছে। একজন পিঠে ডলাডলি করছে… দূর্বল হাত তুলে আমি তাকে থামানোর চেষ্টা করলাম। সারা শরীর ভেজা।
ঃ বাঁইচ্চা গেছেন ভাই…। এক মুরুব্বি গোছের লোক বলে। আমি চোখ খুলে দেখলাম গায়ের জামাটা নেই। একটা পলিথিন এর উপর মাটিতে শুয়ে আছি।
ঃ নাম বলতে পারবেন…? বাড়ি কই…? এখন কেমন লাগতেসে? আরেকজন এক নাগাড়ে প্রশ্ন করে গেল। এ লোকটাই বোধহয় আমার পিঠ ডলাডলি করছিল।
ঃ … রাসেল……। … চাঁদপুর… মতলব যাচ্ছিলাম… লঞ্চ ডুবে গেল… শাহরিয়ার ভাই…। আমার মাথা তখনো পুরোপুরি পরিষ্কার হয়নি।
ঃ হ… লঞ্চ ডুবসে আরো মাইল চারেক পরে… আপনারে আমি পাইসি নদীর পাড়ে। একটা ব্যাগ ধইরা পইড়া আছিলেন। এতদূর সাঁতার দিলেন কেমন?
ঃ আমি সাঁতার জানি না… শাহরিয়ার ভাই সাথে ছিলেন… আমার সাথে আরেকজন ছিলেন সে কই? আমি এবার উঠে বসেছি, শরীরে প্রচন্ড ব্যাথা।
জনা বিশেক লোক এই সাত-সকালেও জড়ো হয়ে গিয়েছে। আমার মাথা আস্তে আস্তে কাজ করা শুরু করেছে। শাহরিয়ার ভাই আমার হাতে ধরে ছিলেন… লঞ্চ অন্ধকার… ডুবছে… তারপর … সেই ডাফেল ব্যাগ…!
ঃ ভাই … আপনে একলাই ভাইসা আসছেন … … আল্লাহর কি কুদরত। সাথে আপনার ব্যাগ ও আছিল…!
ভীড়ের পেছন থেকে একজন একটা ব্যাগ এগিয়ে দিল…।
আমার মেরুদন্ড বেয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে গেল… পরিচিত সেই কালো রঙের ঢাউস সাইজের ডাফেল ব্যাগ। শাহরিয়ার যে ব্যাগের ভেতর আমার হাত ঢুকিয়ে দিয়েছিল।
আমি বিশ্বাস-অবিশ্বাসের এক দোলাচালে পড়ে গেলাম। আমার কাদামাটি মাখানো শরীর, সকালের ঠাণ্ডা বাতাসে শীত শীত অনুভুতি সব এক লহমায় উড়ে গেল।
আমি শরীরের সব শক্তি খরচ করে উঠে দাঁড়ালাম… একজন আমার দিকে সেই ডাফেল ব্যাগ আর একটা শুকনা গামছা এগিয়ে দিল। আমি তখনো একটা ঘোরের মধ্যে আছি।
ঃ ভাই ব্যাগ কেউ নিবে না… আপনে একটু বিশ্রাম নেন, জুস খান। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া করেন বাইঁচা গেছেন এইজন্য… শুনলাম অনেক মানুষ নিঃখোঁজ আছে এখনও…।
আমার কানে তখন কিছুই যাচ্ছে না। আমি শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে কালো ডাফেল ব্যাগটা আঁকড়ে ধরে আছি। আর দুচোখ বেয়ে অঝোরে কান্না… বেঁচে থাকার আনন্দে।
—-
আশেপাশের মানুষের মুখে তৃপ্তির হাসি। একটা ধাড়ি লোক চকচকে একটা কালো রঙ্গের ব্যাগ বুকে আঁকড়ে ধরে কান্না করছে এটা সবাই বেশ স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছে। বেঁচে থাকার আনন্দ সবাই বোঝে। কিন্তু তারা কেউ খেয়াল করেনি লোকটার শরীর আর জামায় পানি-কাদা লেগে থাকলেও তার কালো ব্যাগটা একদম শুকনো আর ঝাঁ চকচকে নতুন।
0 Comments