বয়স বাড়ার সাথে সাথে সবচেয়ে কঠিন যে জিনিসটা আপনি বুঝতে পারবেন সেটা হছে, আপনি একা। এই পুরো পৃথিবী ভর্তি মানুষের মাঝখানেও আপনি একা!
স্কুলে থাকতে আপনার একটা লক্ষ্য থাকে প্রতিদিনের। বাড়ির কাজ, স্কুলের পরীক্ষা, খেলার মাঠের রাজনীতি অথবা নিজেকে আর দশজনের থেকে সেরা প্রমান করার চেষ্টা, নিদেন পক্ষে বড় হয়ে বড় কিছু একটা করার চেষ্টা। অনেক বন্ধু থাকে তখন, সময় কাটানোর কোন অভাব নেই।
আস্তে আস্তে বয়স যত বাড়ে সেই বন্ধুরা গায়েব হয়ে যায়, বয়স যখন আরো বাড়ে নিজের পরিবারের সাথেও আপনার দূরত্ব বাড়ে। মনখুলে সেই আড্ডা দেবার লোকগুলোও আর থাকে না। সবারই একটা তাড়া থাকে, শুন্য বাড়িতে ফেরার তাড়া। যেখানে গোমড়া মুখ করে বসে থাকতে হবে বেশিরভাগ সময়েই।
এই পুরো পৃথিবীতে তখন একটা মানুষ খুঁজে পাবেন না যার সাথে মন খুলে দশমিনিট কথা বলতে পারবেন। হাসিখুশি আমাদের এই চেহারাগুলোর আড়ালে একটা বিষন্নতা লুকিয়ে রেখে আমরা বলে চলি, “জ্বী, ভাল আছি।”
অথচ সেই মানুষটা নেই যাকে কোন রাখঢাক না করেই বলতে পারতাম, মন ভালো নেই, কিচ্ছু ভালো লাগে না। সে শুধু শুনেই যেত কোন মন্তব্য করত না।
আপনার যদি এরকম কেউ থাকে, যে আপনাকে কাঠগড়ায় দাঁড় না করেই আপনার কথা শুনে যাবে, তবে আপনি পৃথিবীর সেই ১% সৌভাগ্যবানদের একজন।
পুরুষ মানুষ হবার যন্ত্রণা আরো বেশি। ঠিকমত মন খুলে কাঁদাও যায় না। আমাদের এই বাতিল সমাজ শিখিয়েছে শক্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। কোনভাবেই দূর্বলতা দেখানো যাবে না। কারন তোমার দিকে তাঁকিয়ে আছে আরো বেশ কয়েকটা মুখ। কোনভাবেই বলা যাবে না তুমি ক্লান্ত। ছেলেরা কাঁদে নাকি?
না কাঁদে না… ছেলে থেকে পুরুষ হবার প্রক্রিয়ায় তার বের না হতে পারা কান্না ভেতরে রক্তক্ষরণে পরিনত হয়। পৃথিবীর কাউকেই সে আর নিজের আবেগের কথা বলে না, কাউকেই বিশ্বাস করে না। আর কোনক্রমে যদি বিশ্বাস করে একবার ঠকে যায় তবে সে আজীবন সেই গ্লানি বয়ে বেড়ায়। কারন সমাজটা তাকে শিখিয়েছে ভুল করা যাবে না।
আদিমকালে শিকার আর হিংস্র বন্য জন্তু-জানোয়ার থেকে বাঁচার জন্য যে কঠোরতা পুরুষ মানুষ শিখেছিল, আজকের সভ্য সমাজেও তার ব্যতিক্রম নেই। এখনো ব্যাথা পেলে আমরা তাকে কাঁদতে দিতে চাই না। সব দায় আর বোঝা বহনের দায়িত্ব তাকেই দিতে চাই। এখনো ছেলে শিশু আমাদের আরাধ্য থাকে পরিবার গঠনের পরে।
আমাদের সেই আমুদে কিশোরেরা তাই বড় হবার প্রক্রিয়ায় খুব একা আর কঠিন চেহারার হয়ে যায়। অথচ এদের কারো সাথে একটু দরদ মাখানো গলায় কথা বললে দেখবেন এরা কত সহজে আপন করে নেয় অপরিচিতকে।
আপনি কখন বুঝবেন আপনি খুব একা? যখন দেখবেন সবাই দরকারে বা বিপদে পড়লেই শুধু আপনার কথা মনে করে। অথচ কেউ হুট করে শুধু আপনাকে জিজ্ঞেস করে না, কেমন আছেন? মন ভাল নেই কেনো?
ঠিক করে ভেবে দেখুনতো, বিপদে পড়লে আপনি কাকে ফোন দেবেন, বা কোন সমস্যায় পড়লে প্রথমে কাকে জানাবেন? এরকম কি কেউ আছে আপনার? মন খারাপ হলে কাউকে ফোন করে অহেতুক গল্প করার মত কেউ আছে?
যদি না থাকে তবে আপনি একা। বয়স ত্রিশ থেকে চল্লিশের ঘরে যখন চলে আসবে আপনি একদিন হুট করে বুঝতে পারলেন আপনি বিপদে পড়লে আপনার সৃষ্টিকর্তা বাদে আর কাউকে সাহায্যের জন্য বলার নেই। কেউ আপনার সাহায্যে এগিয়ে আসবে না। এমনকি বিপদের সময় শুধু হাতটা ধরে রেখে স্বান্তনা দেবার লোকও নেই।
নিশ্চিতভাবে জেনে নিন, আপনি একা। এভাবেই আপনাকে বাঁচতে হবে। হাজার কোটি টাকাও আপনার এই একাকীত্ব কাটাতে পারবে না। পৃথিবীর বিশুদ্ধতম সংগীতের পরেও আপনার নিঃসঙ্গতা কাটবে না।
সৃষ্টিকর্তাও নাকি চাননি আমরা একা থাকি, তাই তিনি আমাদের জোড়ায় জোড়ায় বানিয়েছেন। অথচ কি নির্মম পরিহাসে আমরা সবাই ভেতরে ভেতরে খুব নিঃসঙ্গ হয়ে যাই। ঘরভর্তি লোক রেখেও আমরা আপনজন খুঁজে বেড়াই।
এমন একজন মানুষের সন্ধানে থাকি যে শুধু শুনবে, কিছু বলবে না। বৃথাই সে চেষ্টা… যেভাবে একলা এসেছি, এই পথের শেষে আবার একলাই ফিরে যেতে হবে।
0 Comments