কারো সাথে কথা বলার শুরুতেই যখন সে নিজের পরিচয় দেয়া শুরু করে তার পোষ্ট বা চাকরির পদবি দিয়ে, তখন আক্ষরিক অর্থেই তার সাথে আর কোন ধরনের “ইন্টার্যাকশনে” যাবার ইচ্ছা মরে যায়।
মানুষের নিজস্ব পরিচয় হতে হয় তার ব্যবহারে আর বুদ্ধিমত্তায়।
আরেক দল লোক দেখেছি কেউ উঁচু কোনও পোস্টে জব করছে জানার পর সাথে সাথে তার গলার স্বর পরিবর্তন হয়ে যায়। কেমন যেন একটা তেলতেলে ভাব চলে আসে। না চাইতেই চা খাবার পরে বিল দিয়ে দেয়, সিগারেট খায় কিনা জিজ্ঞেস করে। … এরা আমাদের দেশেরই মানুষ। ক্রমাগত সিস্টেমের ডলা খেতে খেতে শিখে গেছে তেলামিই হল এই দেশে টিকে থাকার মোক্ষম অস্ত্র।
আমি বাস্তবিকই বেশি মানুষের সাথে কথা বলতে চাই না। যখন কোথাও আড্ডা দেই বা অপিরিচিত কারো সাথে আলাপচারিতায় যাই, আমি সচেতন ভাবে এড়িয়ে যাই তার পেশা, পদবি এবং সে কত ক্ষমতাধর এইসব বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে।
কিন্তু খুব বেশিক্ষন পারা যায় না। কারন সামনের ব্যাক্তিটি নিজে থেকেই একসময় জাহির করা শুরু করে সে কি করে, তার ভাই কি করে, তার চাচা কোন ব্যাংকের এমডি, সরকারি কোন মন্ত্রী তার মামা হয় এবং কোন চেয়ারম্যানের আর থানার কোন অফিসারের সাথে সে নিয়মিত আড্ডা দেয়।
নিদেনপক্ষে বলে বসে তার শুশুরবাড়ীর লোকজন কে কোন সরকারী অফিসে বসে আছে।
আমি এড়িয়ে চলতে চাই। পারিনা…। এরকম সংকীর্ণমনার সংখাটাই বেশি।
এই স্বভাব পরিহার করা অতীব সোজা একটি কাজ। শুধু নিজের প্রতি বিশ্বাস আর ভালোবাসা রাখুন। নিজেকে সম্মান করতে শিখুন। তাহলেই দেখবেন কোন উঁচু পোস্টধারীকে তেল দেবার ইচ্ছাটা আপনার থাকবে না। আত্মমর্যাদা না থাকলে এই বেঁচে থাকার দরকারটাই কি?
বাচ্চার স্কুলে যাবার সুবাদে বেশ কিছু লোকজনের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে। এদের মধ্যে একজন একবার আমাকে বলেছিল- “আল্লাহ সাপ বানিয়েছে গাছের বিষ টেনে নেবার জন্য।” আরেকজন বেশ দম্ভের সাথে বলেছিলঃ – ” এই পৃথিবীর তাবৎ আবিষ্কার এবং আইন কানুন কুরান থেকে এসেছে”।
আমি এখন আর ভুল শোধরাতে যাই না। কারন শেখার মানসিকতা না থাকলে আপনি যার কাছ থেকে শিখবেন তাকে সবসময়ই পাগল আর বাচাল মনে হবে।
আমি ভুল করে শিখি আবার অন্যের করা ভুল থেকেও শিখি, প্রতিনয়ত শিখি। একটা নতুন বই পড়ার পরে সেটা নিয়ে আলোচনা করার জন্য লোক খুঁজি, কিন্তু পাই না। আমাকে হতাশ করে হোমিওপ্যাথির ভক্ত আর তুকতাকে বিশ্বাস করা লোকজন। আশেপাশে এরা পিলপিল করে অগুনতিতে।
আমি এখনো বুঝি না, ইউক্রেন আক্রমন করে রাশিয়ার কি লাভ হয়েছে? কিছু সৈন্য আর মানুষ মরে যেয়ে পৃথিবীর কি উপকার হয়েছে।
আমি বুঝতে চাই, সৃষ্টিকর্তা যদি একটাই পৃথিবী বানিয়ে থাকে, তবে তিনি এই কল্পিত বর্ডার কেন আগে থেকেই দেননি। ধর্ম আর দেশ রক্ষার নামে মানুষ এই যে অকাতরে মরে আর মারে, তাতে সামষ্টিকভাবে প্রজাতির কি লাভ হয়? এরা কিভাবে সৃষ্টির সেরা জীব হতে পারে?
আমি তাই মানুষ দেখি কিন্তু বুঝি না।
চরিত্র বুঝতে না পারা একটা লেখকের জন্য চরম হতাশার। কারন গল্প ফাঁদলেও সেটা বাস্তব মানুষের চরিত্রের উপর ভর করেই দাঁড়াতে হবে। আমি মাঝে মাঝেই এই হতাশার মাঝ দিয়ে যাই। যদিও অনেক শুনেছি মানুষ বিচিত্র চরিত্রের হয়, কিন্তু আমি বেশিরভাগই সাদামাটা চরিত্রের দেখা পাই। এদের প্রধান কাজ তিনটা, খাওয়া, যৌনতা আর অর্থ উপার্জন।
আমি আমার সন্তানকে জিজ্ঞেস করি মাঝে মাঝে সে কি হতে চায়?
সে একেক বার একেক রকম উত্তর দেয়। কখনো সে শিক্ষক হতে চায়, কখনো সে গেইমার বা পেইন্টার, আবার কখনও সে বলে, “জানি না, আমি যে এখনও অনেক ছোট”।
আমি শুনে যাই, আসলেও সে কি হতে চায় বা পারে সেটা আরো অনেক পরের আলোচ্য বিষয়। আমি শুধু শুনতে চেয়েছিলাম তার কল্পনার দৌড় কতদূর।
আশেপাশের যে মানুষ দেখি আমি, এরা কেউ কল্পনা করতে পারে না, এদের ভালো কিছু হবে বা করতে পারি এই কল্পনা করার শক্তিটাই হারিয়ে গেছে।
শিশুরা এখনো কল্পনা করার শক্তি রাখে। এদের বাড়তে দিতে হবে, এদের কল্পনার উপাদান জোগাতে হবে। হয়ত তবেই এক বিশ্ব, এক প্রজাতি হিসেবে আমরা মাথা তুলতে পারব। খুব সহজেই চলে যেতে পারব গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে।
অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে? রাইট ভাতৃদ্বয় বিমান আবিষ্কারের পূর্বে অনেকেই অসম্ভব বলেছিল। মোবাইল এবং টিভি আবিষ্কারের পরে এরাও অসম্ভব আর হারাম ছিল অনেক দেশে।
যদি মানুষ তার কল্পনাকে সীমাবদ্ধ করে ফেলে একটা ধর্ম বা সংস্কৃতির গন্ডিতে, তবে দুই মিলিয়ন বছরের ইভোলিউশন বৃথা যাবে।
[ পুনশ্চঃ লেখালেখি একটা ক্লান্তিকর কাজ। অনেক পড়তে হয় অনেক চিন্তা করতে হয়, মানুষের চরিত্র বুঝতে হয়। সেই সাথে সবচেয়ে কঠিন কাজ “কল্পনা” করতে হয়। আমি একজন লেখক এই পরিচয় কাউকে দেয়াটা এই দেশে একধরনের কৌতুকের মত। কারন এখানে মানুষ মানুষকে মাপে পদবী আর অর্থের ক্ষমতা দিয়ে। ]
(অসমাপ্ত)
0 Comments