বন্ধুত্বে বয়স কোন বাধা না হলেও বয়সের সাথে সাথে বন্ধুত্বের ধরন পাল্টাতে বাধ্য। সেই ষোল বছরের আমি বন্ধুত্বের যে সংজ্ঞা জানতাম আর বিশ্বাস করতাম, ত্রিশের পর এসে তা আমূল বদলে গেছে। কেমন আছে ত্রিশের পরে আমাদের বন্ধুত্ব?
স্কুলের বেশিরভাগ বন্ধুই গায়েব হয়ে গেছে। যাদের সাথে দিনের আট ঘন্টা আর সন্ধ্যার আড্ডায় দুই ঘন্টা কাটতো, তারা জীবনের হাঁটে বিকিকিনি করতে করতে অচেনাই হয়ে গেছে। যে ছেলে স্কুলে থাকতে চরম রকমের দুষ্ট ছিল আজ সে বিদেশে কোন এক ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়েছে, কেউ মাইক্রোসফটে, আবার কেউ দেশে/বাইরে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার। সবই ফেইসবুকের কল্যাণে জেনে যাওয়া।
এখন আর কারো সাথেই কথা হয় না। এক দেশে, এক শহরে থাকলেও কথা হয় না। একদম কাছের দুই একজন বাদে স্কুলের বন্ধুদের সাথে আর মোবাইলেও যোগাযোগ হয় না। জীবন বড় ব্যস্ত, এই বেঁচে থাকা বড় সময় মেপে চলা। জীবনের খোঁজে দেশ ছেড়ে বাইরে চলে যাবার সংখাটাও তাই নগন্য নয়।
বুকের খুব কাছে রয়ে যাওয়া তিন-চারজন স্কুল জীবনের বন্ধু আছে। মৃত্যু পর্যন্ত এরাই থাকবে মনে হচ্ছে। বাকিরা স্মৃতির খাতায়। হয়ত কোন একদিন পৃথিবীর কোন এক শহরে হঠাত দেখা হয়ে যাবে, অচেনা হাসিমুখে। আচমকিতে আমরা দুজনেই চমকে উঠব। চেনা চেনা লাগবে, আবার অস্বস্তিতে জিজ্ঞেস করা হয়ে উঠবে না, কেমন আছিস?
কৈশোরের প্রচন্ড আবগে স্কুলে একসাথে পড়া সবাইকে আমি একসময় বন্ধু বলে ভাবতাম। কিন্তু বড় হবার সাথে সাথে সে আবেগ কেটে গেছে। কলেজে ওঠার পর চলার পরিধি বড় হয়, আবেগে নতুন মানুষ যুক্ত হয়। বুঝতে শিখি আমার চেনা জগতের বাইরেও আরেকটা জগত আছে। আরো অনেক বন্ধু হবার আছে।
কিন্তু কেমন যেন জমে না ব্যপারটা। কলেজের জীবন হুট করে শেষ হয়ে যায়। এখানে ঘটা ঘটনার সাথে মেলাতে গিয়ে মনে হয় স্কুল জীবন ছেড়ে আসাটাই একটা ভুল হয়েছে। স্কুলের বন্ধুদের সাথে যেমন অবলীলায় সব বলা যেত, এখানে সেটা করা যায় না। সবাই কেমন যেন একটা আড়াল রেখে চলে।
ক্রাইম পার্টনার বলে একটা কথা আছে, আমার স্কুলের বন্ধুরা ছিল সেটা। কলেজ লাইফে তাই অনেক সহপাঠী থাকলেও বন্ধু হয়ে ওঠা হয়নি,এমনকি বান্ধবীও নয়। এ সময়টা অনেকটা ধরি মাছ না ছুঁই পানির মত কেটে গেছে। দিন শেষে সেই স্কুলের বন্ধুদেরই খুঁজে নিয়েছি বুকের মধ্যে জমানো কথাগুলো বলার জন্য।
আমার এক কলেজ শিক্ষক বলেছিলেন, “তোমার জীবনের সেরা বন্ধুগুলোকে পাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে, এরাই আজীবন তোমার বন্ধু রয়ে যাবে”।
তার এই কথাটার মানে তখন বুঝতে পারিনি। বুঝেছি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি তখন। স্বার্থপরতা, প্রেম-ভালোবাসা, অর্থ সংকট এই বয়সটাতেই মাথায় ঢোকে চরমভাবে। জীবন সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে আমি তখন ব্যাস্ত।
দু’হাত উজাড় করে ভালোবাসা দেয়া এই বন্ধুদের খুব কাছ থেকে তখন দেখেছি আমি। পরামর্শ করে কাজ করা যায় এরকম বন্ধুদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পেয়েছি। মূলত, এই বয়সে এসে মানুষ জীবনকে অন্যভাবে আবিষ্কার করে। ক্লাসের সব সহপাঠী আপনার বন্ধু না হলেও প্রতিযোগী নয়। জীবন বদলে দেয়া যে সিদ্বান্তগুলো মানুষ নেয় সেটা এই বিশ্ববিদ্যালয়েই এসে হয়।
খুব অবাক করা বিষয় হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেই আপনি প্রথম বুঝতে শিখবেন আপনার দুইটা জীবন। একটা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে, আরেকটা তার বাইরের। আপনার দুইটা বাড়ি, একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে, আরেকটা পৈতৃক। আপনার দুইটা পরিবার, একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে, আরেকটা জন্মসূত্রে পাওয়া। এ যেন নতুন করে জন্ম নেয়া।
এই বন্ধুত্বেও দূরত্ব বাড়ে, বয়স যখন ত্রিশ হয়ে যায় ফিকে আসতে থাকে সম্পর্ক। বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে আসার অনেকটা সময় হয়ে গেছে। জীবনের গল্পে নতুন মানুষ এসেছে, পরিবার হয়েছে নিজের। প্রায়োরিটি লিস্টে যোগ-বিয়োগ হয়েছে নতুন মুখ।
তবু দুম করে কোন এক দুপরে ফোন দিয়ে বসা হয়। কোথায় আছিস, আসছি। এক সাথে খাওয়া, আড্ডা হয়। আবার একটু পরেই হারিয়ে যেতে হয় কাজের রাজ্যে। হয়ত বছরে একদিন কোন এক শুক্রবার প্লান করে বের হওয়া হয় একসাথে সময় কাটানোর জন্য।
সেই আগের মতই আবেগ, অকৃত্তিম দু’হাত বাড়িয়ে বুকে জড়িয়ে নেয়া। কোন কৈফিয়ত নেই, কেন দেখা হয় না, কেন ফোন করি না- তার জবাবদিহিতা নেই। শুধু থাকে আস্থার একটা হাসি। এই শহরে খুব দরকার এরকম কিছু মূহুর্তের, স্বার্থ নেই, শুধু হাসিমুখ দেখার জন্য।
বয়স ত্রিশ মানেই, নানাভাবে নিজেকে ব্যাস্ত করে ফেলার সময়। নতুন বন্ধু বানানোর সময় কোনভাবেই পাওয়া যায় না। আগের যে বন্ধুরা আছে ঘুরেফিরে এই শহরে তাদের সাথেই দু’দন্ড কথা বলতে ইচ্ছে করে। বাকিদের সাথে হাসিমুখে শুধু কেমন আছি আর সালাম বিনিময়।
বন্ধু মানেই হুট করে ফোন দিয়ে কোন কারন বাদেই একটা গালি দিয়ে দেয়া। কেন সে গালি দিল সেটা আমিও জানি না, সেও জানে না। কেউ কৈফিয়ত চাইনি, দুজনেই জানি অপরপ্রান্তে মুখটা হাসিহাসি হয়ে গেছে।
বন্ধু মানেই, ২৪/৭ যেকোন সময় ফোন দিয়ে বলা চলে সাহায্য দরকার। বিনা প্রশ্নে অপরপাশ থেকে উত্তর আসে, আসছি।
খুব…… খুব মন খারাপের এই শহরে যে কথা প্রেমিকা বা স্ত্রীকেও বলা যায় না, অঝোরে কাদঁতে কাঁদতে সেকথা বন্ধুকে হুট করে বলে ফেলা যায়, নির্দ্বিধায়, নিঃসংকোচে।
ত্রিশের পরে আর নতুন করে বন্ধু হয় না, এটা জীবন নিয়ে ব্যস্ত থাকার বয়েস। ত্রিশের পরে যাদের সাথে নতুন করে পরিচয় হয় বা বন্ধু বলি তারা অনেকটা সহকর্মীর মত। একসাথে স্বার্থের জন্য থাকবে, কিন্তু আপনার আজাইরা প্যাচাল এক কাপ চায়ের সাথে শোনার সময় নেই। আপনার সাথে সিগারেট ভাগাভাগি করে খাবার সময় তার নেই। হটাত রাস্তার মোড়ে দেখা হয়ে গেলে তার জন্য জরুরী কাজ ফেলে আপনি দাঁড়িয়ে যাবেন না, হাত নেড়ে যে যার যার কাজে চলে যাবেন।
বন্ধু মানে অযথাই যাকে একটা মেসেজ দিয়ে বলা যায়, ভাল্লাগেনা ।
বয়স ত্রিশ পেরিয়ে গেলে খুব অবাক হয়ে আপনি দেখবেন এরকম বন্ধুর সংখ্যা মাত্র চার কিংবা পাঁচ জন, এবং আপনারা সবাই সবাইকে চেনেন।
বন্ধুত্ব বড় নাকি প্রেম বড় এই প্রশ্নের উত্তর খুব সোজা।
বন্ধুত্ব।
প্রেমে/বিয়ের মাঝে কিছু চাহিদা থাকে, সৌন্দর্য এবং সেক্স তার মধ্যে প্রধান। আপনার প্রেমিক বা প্রেমিকার মাঝে আপনি এই দুটা জিনিস সবসময় খুঁজে বেড়াবেন। যখন এগুলোর অভাব দেখা দেবে, তখন সম্পর্কে টানাপোড়ন শুরু হতে বাধ্য। এরপর পারিবারিক নিত্যদিনের ঝামেলা আর বিচার আচার থাকবেই। বিয়ে করার পর তাই এই বাধ্যবাধকতার জন্যই মানুষ নিজেকে খাঁচায় বন্দী পাখির সাথে তুলনা করে।
বন্ধুত্বে এরকম কিছু নেই। মাসের পর মাস দেখা না হলেও অভিমান নেই, ভুল বোঝাবুঝি নেই। হটাত যে কোনদিন মেসেজ দিয়ে বলা যায়, মুভি দেখতে যাচ্ছি, যাবি? না আসলেও ক্ষতি নেই, রাগ করা নেই, কৈফিয়ত চাওয়া নেই।
বন্ধু দেখতে কালো, ফর্সা, জোরে কথা বলে, নাক ডাকে, গরীব, ধনী এরকম কোন পাওয়া না পাওয়ার হিসেব নেই। বন্ধু মানে শুধু একসাথে হেঁটে যাওয়া আরেকটা সত্ত্বা। সে খারাপ ভালো যাই হোক আপনি তাকে বন্ধু হিসেবেই গ্রহন করে নেন একটা কমপ্লিট প্যাকেজের মত।
বাছ-বিচার করে বিয়ে-শাদী বা প্রেম হতে পারে বন্ধুত্ব হয় না। বন্ধুত্ব থেকে প্রেম হতে পারে, কিন্তু একবার প্রেম হয়ে যাবার পর সেটা আর বন্ধুত্ব থাকে না। আপনার স্ত্রী বা প্রেমিকা আপনার বন্ধু নয়। কারন স্ত্রীকে ডিভোর্স দেয়া যায়, বন্ধুকে নয়।
ভালো থাকুক পৃথিবীর সকল মানুষের বন্ধুরা।
0 Comments