আমি তখন সিটি কলেজে পড়ি। আমাদের বায়োলজি প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস চলছে। ক্লাসের মাঝখানে মাথার উপরের সিলিং ফ্যানটা হঠাৎ করে একটা পাখা খুলে গেল। ভীষন জোরে গিয়ে দেয়ালে আছড়ে পড়ল সেটা। ভাগ্যিস কেউ আহত হইনি আমরা। তবে ম্যাডাম খুব ভয় পেয়ে গেছিলেন। ফ্যান পরের দিনই ঠিক করা হয়েছিল কিন্তু অনেকদিন সেই ফ্যানের নিচে দাঁড়াতে আমার ভয় লাগত।
আলিনার স্কুলে আজকে একই রকম একটা ঘটনা ঘটেছে। তার বিজ্ঞান ক্লাস চলার সময় মাথার উপরের একটা ফ্যান সশব্দে স্পার্ক করে পুড়ে গেছে। অন্তত আলিনার ভাষ্যমতে, সে নীল স্ফুলিঙ্গ দেখেছে এবং শব্দে সবাই ভয় পেয়েছে, স্যার সহ। আমি ঘটনাটা খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই শুনলাম। খুব বেশি রিঅ্যাক্ট করলাম না। যদিও জানি এই রকম ঘটনা ঘটা উচিৎ নয়। ক্লাসের ফ্যানগুলো নিশ্চয়ই পুরনো হয়েছে এবং ওয়ারিং এ ঝামেলা আছে। আমার জানামতে তার পুড়ে না গেলে এদেশে কেউ এইসবের দিকে নজর দেয় না। মনে করে একবার লাগিয়েছে মানে আজীবন চলবে।
স্কুল বাচ্চাদের জন্য নিরাপদ জায়গা হবার কথা হলেও , আমরা সেটা দিতে পারছি না।
আলিনার যা কিছু ভাল লাগে সে মাঝে মধ্যেই আমার সাথে শেয়ার করে। যেমন একদিন এসে বলল তাদের অংকের টিচার আরমান স্যার খুব ভালো অংক বোঝান। আমি ঈষৎ বিস্মিত হলাম। ক্লাস ফোর পড়ুয়া কেউ গণিতের টিচারের প্রশংসা করে না। তারমানে এই শিক্ষক আসলেই গণিত বাচ্চাদের জন্য সহজ করে দিচ্ছেন।
– বাবা জানো, দোতলায় একটা সুন্দর টয়লেট আছে। অনেক পরিষ্কার।
– তুমি সেখানে যাও না?
– না…ওটা বড় আপুদের। ওখানে গেলে বকা দেবে।
– তাহলে তুমি কোন টয়লেটে যাও?
– যাই না তো। আমাদের ওয়াশরুম নোংরা থাকে। কারন ছোটরা টয়লেট নোংরা করে ফেলে।
স্বাস্থ্যগত সমস্যা আর জেনারেল হাইজিন এর শিক্ষা বাচ্চারা সাধারণত তার পরিবার থেকে পায়। স্কুলে যখন অনেক বাচ্চা একসাথে থাকে তখন তারা বুঝতে পারেনা যে এখানে বাসার মত করে ওয়াশরুম ব্যবহার করলে হবে না। নিজেকেই ফ্ল্যাশ করতে হবে, পরিচ্ছন্ন হতে হবে। এটাও একটা শেখার বিষয়। বাচ্চাদের এই শিক্ষাটা দেয়া হয় কিনা স্কুলে আমি জানি না। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এটা অন্তর্ভুক্ত আছে কি?
স্কুলের শ্রেনী পরীক্ষায় আলিনা মোটামুটি নম্বর পেয়েছে। নম্বর নিয়ে যদিও আমি চিন্তিত থাকি না। আমি শুধু চাই সে বিজ্ঞান আর গনিতে ভাল করুক। যুক্তি বুঝতে এ দুটো জিনিসের খুব দরকার।
বিজ্ঞান খাতায় সে দুটো ভুল লিখেছে, প্রথমটা হচ্ছে – তিমি মাছ নাকি পুকুরে থাকে। আরেকটা হচ্ছে, কচুরিপানা সমুদ্রে জন্মায়। আসলে একটার জায়গায় আরেকটা লিখে ফেলেছে।
তাকে যখন জিজ্ঞেস করলাম তিমি মাছ দেখেছ কখনো? সে না বলল।
– Whale দেখেছো কখনও?
– হুম।
– ওইটাকেই বাংলায় তিমি মাছ বলে। ওরা সমুদ্রে থাকে। পুকুরে থাকার মত তিমি মাছ নেই।
– অহ… আমি জানতাম না।
– তিমি কিন্তু আসলে মাছ না। ওরা স্তন্যপায়ী প্রানী। অনেক বুদ্ধিমান।
এরপর তার মাথায় জিনিসটা ঢোকানোর জন্য আরো কিছু বেদরকারি তথ্য দেয়ার চেষ্টা করলাম। তবে তাতে সে কান দিলো না।
মানব মস্তিষ্ক অদ্ভুত আর রহস্যময় একটা জিনিস। রহস্যময় একারনেই যে আমরা এখনও একে পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি। কিছুটা জেনেছি কোন অংশ কি কাজ করে, টিউমার হলে কিভাবে সার্জারি করতে হয়, নিউরনের সংযোগ কিভাবে ঘটে, এরা কেন মরে যায়, ইত্যাদি।
আমরা স্বপ্ন কেন দেখি সেটা জানি, কিন্তু কি স্বপ্ন দেখব সেটা বলতে পারিনা। এখানেই মস্তিষ্কের রহস্যময়তা। আমাদের চারপাশের যে বাস্তব জগত তা আসলে আমাদের মস্তিকের ভাবনা-চিন্তারই প্রতিফলন। মস্তিষ্ক চাইলে এটা অন্যভাবে দেখাতে পারতো আমাদের। আমাদের বর্তমান বাস্তবতার বেশিরভাগই আমাদের মস্তিষ্কের কল্পনা।
নিউরোলিংক নামে একটা কোম্পানি আছে। এরা হয়ত আর কয়েক বছর পর আমাদের পৃথিবীর শেখার পদ্ধতি বদলে দেবে। এখন কোন কিছু শিখতে গেলে যেমন ঘন্টার পর ঘন্টা সময় ব্যয় করতে হয়, ভবিষ্যতে এই কষ্ট আর করতে হবে না। কারো ড্রাইভিং শেখা দরকার হলে সরাসরি মস্তিষ্কে ডেটা পাঠিয়ে সেটা সংরক্ষন করে ফেলা হবে। মাথার ভেতর খুব পাতলা আবরনের একটা চিপ বসানো হবে টার্মিনালের জন্য। এই চিপ মস্তিষ্কের তথ্য আদান প্রদান করবে বাইরে থাকা কম্পিউটারে।
বিশেষ অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে তার সকল স্মৃতি মুছে ফেলা হবে। তাকে নতুন পরিচয় দেয়া যাবে। জন্মান্ধরা সহজেই দেখতে পারবে বিশেষ সেন্সর দিয়ে। পারকিনসন্স এর মত রোগ নির্মূল করা সম্ভব হবে।
ভবিষ্যৎ অনুমান করা কঠিন, কারন প্রযুক্তি হুট করে এক লাফে একশ বছর এগিয়ে যেতে পারে। তবে আমি আশা করি ভবিষ্যতের মানুষেরা এই মুখস্ত বিদ্যার শিক্ষা পদ্বতি থেকে বের হয়ে আসবে। যে জিনিস বইয়ে পাওয়া যায়, গুগল করলেই উত্তর মেলে, সেরকম অনেক অপ্রয়োজনীয় জিনিস বাচ্চাদের মুখস্ত করতে দেয়ার কোন মানে নেই। যেমন, ডিকশনারী মুখস্ত করার কোন দরকার আমি দেখি না। গণিতের সূত্র মনে রাখা দরকার, বোঝা দরকার, কিভাবে সূত্র বানানো হল সেটা জানা দরকার। কিন্তু পাতার পর পাতা গণিত মুখস্ত করার দরকার নেই।
সম্রাট শাহজাহানের জন্মসাল আর তার পিতার নাম মুখস্ত করার দরকার নেই। যে কবিতা ভালো লাগেনা, সেটাও মনে রাখার দরকার নেই। যা স্বঃতস্ফুর্ত ভাবে আসে না, ভালো লাগেনা সেটা সাহিত্য নয়। জোর করে বাচ্চাদের সাহিত্য পড়ানোর নামে কবিতা মুখস্ত করানোর আমি পক্ষপাতী নই। যে বই পড়তে ভালবাসে সে এমনিতেই অনেক কবিতা মনে রাখবে। সাহিত্য সে খুঁজে নেবে নিজের ইচ্ছায়। ভাষা, সংস্কৃতি এগুলো চাপিয়ে দেয়া যায় না। এতে হিতে বিপরীত হয়।
আমরা বাচ্চাদের শেখানোর জন্য এতই জোর করি যে পড়াশোনার পাঠ শেষ করার পরে এরা আর বই হাতে নিতে চায় না। তারা মনে করে পাঠ্যবই পড়ে, মুখস্থ বিদ্যার একটা পরীক্ষা দিয়ে কোনরকমে একটা সার্টিফিকেট পেলেই সে সবজান্তা হয়ে গেছে।
আদতে শেখার মানে হচ্ছে, প্রতিনিয়ত পুরাতন ভুলে যাওয়া আর নতুন করে শেখা।
0 Comments