আলিনা অধ্যায় -১৪: জল পড়ে, পাতা নড়ে

Jul 19, 2022আত্মকথন0 comments

আমি বৃষ্টি পছন্দ করি, অতি বেশি পরিমানেই করি। যখনই বৃষ্টি পড়ে আমার ইচ্ছে করে শহরের রাস্তায় রিকশায় চেপে ছাতা মাথায় ঘুরতে। ছাতাটা অবশ্য আলিনার জন্য। সে বৃষ্টি পছন্দ করলেও ভিজতে খুব একটা চায় না। যখনই ঝুম বৃষ্টি পড়া শুরু হয়, দৌড় দিয়ে এসে আমাকে বলে যায়, “বাবা বৃষ্টি…”।

আমি তাকে নিয়ে ছাদে যেতে চাই, কিন্তু সে তার কম্পিউটার ছেড়ে বাইরে আসতে চায় না। মাঝে মাঝে অবশ্য আমরা বাইরে থাকার সময়েই বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। তখন এই আনন্দ দ্বিগুন হয়ে যায়। রিকশা চেপে আমরা তখন শহরের রাস্তায় ঘুরি। বাতাসে একটা সোঁদা গন্ধ, আর পিচঢলা রাস্তা আরো বেশি কালো লাগে।

স্কুল চলছে – এটা একটা খুশির বিষয়। স্কুলে যেতে আলিনার ভালো লাগে। আলিনা স্কুলে গেলে আমারও ভাল লাগে। এই নিষ্প্রান বাস্তবতার শহরে কিছু শিশুদের একসাথে সময় কাটানো অনেক আনন্দের একটা বিষয়।

প্রথমবার সে স্কুলে পরীক্ষা দিয়েছে। আমি তার ফলাফল নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত না হলেও তার মায়ের সিরিয়াসনেস আমার চোখ এড়ায় না। আলিনা অবশ্য চিল মুডে আছে, এসবে তার কিছু যায় আসে না। আমি নিজে থেকে কখনোই চাইনা সে পরীক্ষা আর ফলাফল নামক এই দুটো জিনিসকে ভয় পাক। চলুক না জীবন হেসে খেলে, কি দরকার তাকে জটিল করে তোলার?


মাঝে অবশ্য আলিনার দাঁতে একটু সমস্যা দেখা দেয়ায় তাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে হয়েছে। সেখানে ওয়েটিং রুমে দীর্ঘ সময় বসে থাকা আমার সহ্য হলেও আলিনার সহ্য হয় না। আমি নানা কথায় তাকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করি। স্কুলের কথা জিজ্ঞেস করি, বন্ধুদের কথা জানতে চাই, মহাবিশ্বের কথা বলি, গ্রহদের কথা বলি।

ঃ বাবা, পৃথিবীর বয়স কত?
ঃ সাড়ে চার বিলিয়ন বছরের মত, সঠিক মনে নেই।
ঃ বিলিয়ন বড় না মিলিয়ন বড়?
ঃ মনে হয় বিলিয়ন। আমি মাথা নাড়ি।

আলিনা সন্তুষ্ট হয় না। গুগলকে জিজ্ঞেস করো। ওতো সব জানে।

ঃ তাইতো, দাড়াঁও দেখে নেই। আমি পকেট থেকে মোবাইল বের করি। এরপর আমরা পৃথিবীর আর মানব প্রজাতির বয়স বের করি, গ্যালাক্সি দেখি।

ঃ গুগল এত কিছু জানে কিভাবে বাবা?
ঃ গুগল কিছুই জানে না। অন্যরা যা জানে সেটাই গুগল সাজিয়ে তোমার সামনে নিয়ে আসে। আমি ওয়েবের জটিল ম্যাট্রিক্স ব্যাখ্যা করার দিকে গেলাম না।
ঃ আচ্ছা, তাহলে গুগলকে জিজ্ঞেস করি, গুগুল তুমি কি জানো না?

আমি হাসি… ঠিক আছে জিজ্ঞেস করে দেখ।

ঃ এটা কি এসেছে? গুগলতো কি জানে না সেটা সে বলতে পারল না!

আমি মোবাইল স্ক্রিনের প্রথম রেজাল্টের দিকে তাঁকাই। সেখানে কোরা থেকে কিছু উত্তর সাজেস্ট করা হয়েছে।

ঃ এটা কোরা, এখানে অনেকেই উত্তর দেয়। তুমি পড়ে দেখতে পার।
ঃ না থাক, গুগল আসলে জানে না।
ঃ গুগল যেটা জানে না, সেটা তোমাকে কি করে বলবে? এই প্রশ্নটাই একটা লজিক্যাল লুপহোল।
ঃ লুপহোল কি?
ঃ যুক্তির মারপ্যাঁচ। এমন কিছু জিনিস আছে যা সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না, কিন্তু সেটা বের করে অন্যকে বোকা বানানোর একটা চেষ্টা। – আমি জানি আলিনা বুঝতে পারেনি। কিন্তু হুট করে মাথায় সঠিক ব্যখ্যাও আসছে না।

ঃ তুমি বেশি কথা বলো, আমার বোরিং লাগছে, আর কতক্ষন বসে থাকতে হবে?
ঃ এই তো আর কিছুক্ষন…। আমাদের কথা চলতেই থাকে।


এক বৃষ্টির দিনে স্কুল ছুটির পর আলিনা আমাকে দেখাল সে কি পেয়েছে, একটা আম।

ঃ তুমি পেয়েছ?
ঃ হ্যাঁ, আমাদের স্কুলের মাঠের ওখানে একটা গাছ আছে। সবাই একটা করে পেয়েছে। নিচে ঘাসে পড়েছিল।

সবাই একটা করে পেলে ব্যাপারটা সন্দেহজনক, যদিও আমি আর কথা বাড়ালাম না আলিনার খুশি দেখে। আম কুড়ানো নিঃসন্দেহে একটা মজার স্মৃতি।

একবার সে আমাকে বলেছিল, তার ক্লাসে একটা কুকুর ঢুকে গিয়েছিল। – আমি গভীর মনযোগ নিয়ে বললাম তারপর?

ঃ তারপর, মিস আর আয়া এসে ওটাকে তাড়িয়ে দিয়েছে!
ঃ অহ, তাহলে তো মজা নষ্ট হয়ে গেল।

যদিও আমি জানি এই অদ্ভুত ঘটনার স্মৃতি তার মাথায় রয়ে যাবে। ক্লাস রুমে কুকুর ঢুকে যাওয়া সাধারন ঘটনা না। এটা মজার এবং একই সাথে ভয়ের।

আমি চাই তুমি পিপড়া চেন, টিকটিকি চেন, কুকুর-বেড়াল চেন, গাছ, ফুল, পাখি, নদী ভালোবাসো। বৃষ্টি দেখে বাতাসে নাক টেনে দেখো ভেজা গন্ধ পাও কিনা!

এই নষ্ট শহরে, আমি চাই কিছুটা হলেও তুমি প্রকৃতি চিনে নাও।

0 Comments

মন্তব্য

দেলোয়ার জাহান

মনের একান্তে কিছু কথা থাকে যা কাউকে বলা যায় না। বলতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খায় আমাকে। সে সকল হাবিজাবি জীবন দর্শন আর কিছু অসময়ের কাব্য নিয়ে আমার লেখালেখির ভুবন।

Pin It on Pinterest

Share This