|| এক ||
আজ আলিনার জন্মদিন, কিন্তু কেক কাটা হয়ে গিয়েছে গতকাল রাত ১১ঃ৩০। কারন কেকটা সুন্দর এবং তখনি কেটে খেতে হবে। অস্থিরতা এবং সারল্য দুটোই আমাদের জীবনে অনুপস্থিত, শিশুদের সেটা আছে। তারা হিংসা বোঝে না, কার কি পেলে খুশি হতে হবে সেটা জানে না, কেন কেউ একবেলা খায় আর কেন কেউ খাবার অপচয় করে এই সমীকরনও তারা মেলাতে যায় না।
জীবনে ভালো থাকতে হলে … শিশুর মত সরল হতে হয়…। আমরা সেটা হারিয়ে ফেলেছি ক্রমাগত। কেউ একজন আমাদের কানের কাছে অনবরত ঘুনপোকার মত বলে গেছে এটা হতে হবে, ওটা পেতে হবে, ওর কথায় রাগ করতে হবে, এর থেকে ভালো থাকতে হবে… ইত্যকার নানা বেহুদা জিনিস। আমরা সেই চিন্তায় নিজের জীবনের সময় অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছি অসম এক প্রতিযোগিতায়।
শিশুদের রাগ হলে তারা চটজলদি তা ঝেড়ে ফেলে দেয় সামনের জনের উপর। মনের মধ্যে তা পুষে রেখে নিজে কষ্ট পায়না আর আরেকজনের জন্য কথার মারপ্যাচ ও তৈরি করে না। আহ … আবার যদি প্রিয় শৈশবে ফিরে যেতে পারতাম … আরেকটিবার … মায়ের স্নেহ আর কোমলে কঠোরে মেশানো বাবার সেই মুখখানি। মহাবিশ্বে সবচেয়ে রহস্যময় এই জিনিস বোধহয় সময়! আমরা এখনো একে পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি।
সময় চলে যায়… নাকি বয়ে যায়? টাইম-স্পেস কি আসলেই প্রসারমান?
বিজ্ঞান থাক… শুভ জন্মদিন স্নেহের আলিনা! যতদিন বেঁচে থাকো আনন্দে থেকো, কারন মানুষের কাজই নানা ভাবে অন্যকে যন্ত্রনা দেয়া। সেই যন্ত্রনা থেকে যতটা পার বেঁচে থাকার চেষ্টা কোরো।
।। দুই ।।
আমি নিজে যা হতে পারিনি, সেটা হবার জন্য আমি আমার সন্তানের উপর চাপ দেব, সেরকম বাবা আমি হত চাই না। এখন থেকেই আমি আলিনাকে বলে দিয়েছি তোমার যেটা ভালো লাগে তুমি সেটাই করো। বাবা শুধু তোমাকে পথ বাতলে দেব – ভালো না খারাপ, বেছে নেবার দায়ভার তোমার। শিশুমনে কতটা যাবে সেটা জানি না, কারন জগতের কোন পরিকল্পনাই ভূল করা বাদে বাস্তবায়ন হয় না। আমরা ভুল করেই শিখি – তবে অবচেতনে ভালো একটা ধারনা ঢুকিয়ে দিতে পারলে তার রেশ আজীবন রয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক।
বাসার একটা কিছু নষ্ট হলে, তার খেলনা ভেঙ্গে গেলে – বাবার কাছে নিয়ে আসা চাই। আলিনার ভাষ্যমতে, “বাবা Fix করে দিতে পারবে”।
একদিন কথায় কথায় তাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ” বাবা মরে গেলে তুমি কি কান্না করবে?”
সরল উত্তর, “না”!
ঃ বাবা মরে গেলে তুমি কার কাছে থাকবে?
ঃ কেন…! মার কাছে…! আলিনা এবারও প্রশ্ন এড়িয়ে যায়। মৃত্যুটা তার কাছে অবাস্তব একটা বিষয়।
ঃ তাহলে বাবা যদি মরে যাই, বা চলে যাই তুমি কষ্ট পাবে না?
ঃ না পাব না… মা মরে গেলে কষ্ট পাব, কিন্তু তুমি মরে গেলে আমাকে নতুন জিনিস শেখাবে কে?
যাক, একটা কিছু অন্তত বাবার দখলে আছে। ভালোবাসাটা বুঝে ওঠার থেকে শিশুরা নির্ভরতা অনেক আগে বোঝে। বাবার সাথে করা অর্থহীন গল্প থেকে যে শেখা শুরু করেছে সেটা বলবত থাকলেই হয় আরো কিছুদিন।
ইউটিউবে কার্টুন আর মোবাইলে গেইম খেলার পাশাপাশি আলিনার একটা দূর্নিবার আকর্ষন জন্মেছে মহাবিশ্বের রহস্যের প্রতি। স্পেস-টাইম, প্লানেট, ব্লাকহোল আর সোলার সিস্টেম নিয়ে তার করা প্রশ্ন মাঝে মাঝে আমাকেও চমকে দেয়। দিতে হয় বিস্তারিত ব্যখ্যা।
আহা শৈশব… আমার শৈশবে যদি এই প্রযুক্তি থাকত… যদি এরকম যুক্তি দিয়ে প্রকৃতির রহস্য বোঝার রাস্তা কেউ দেখিয়ে দিত।
প্রজন্ম এগিয়ে যাচ্ছে, তবুও হাজার বছরের পুরনো সেই বিশ্বাস মাঝে মাঝেই মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে চায়। আমাদের আরো বিজ্ঞান শিক্ষা দরকার, আরো শৈশবকে নিয়ে আসা দরকার তারার ধুলিকনার নিচে। We are children of the Star.
।। তিন ।।
লাবি এসেছে (লাবিবা!), বর্তমানে আলিনার সব থেকে প্রিয় মানুষ। তাই আর কারুর সাথে তার ভাব নেই, দুই দিনের জন্য আড়ি। চাচ্চুর সাথে প্রতিদিন ছাদে যাওয়া হয়। কিন্তু গতকাল বিকেলে চাচ্চু ফোন দেয়ায় –
ঃ হ্যালো … আলিনা তুমি কি ছাদে যাবে?
ঃ না… আমি দুই দিন ছাদে যাবো না… আমার বন্ধু এসেছে তো… এখন রাখি আমি বিজি।
ঃ ও… তাহলে বন্ধুকে নিয়ে ছাদে আসো…।
ঃ No … No … সেটা হবে না… She doesn’t care! আলিনার চটজলদি উত্তর। আর তারপর কিছু না বলেই ফোন কেটে দিল!
ওদিকে এই কনভার্সেশন শোনার পর আমি – ও…ম…গ (OMG)।
ভাব জমাতেও সময় নেয় না, আবার আড়ি দিতেও সময় অপচয় করে না।
ভালো থাকুক আমাদের শিশুরা। এই মহামারী পেরিয়ে আবার হেঁসে উঠুক তাদের পৃথিবী। আমরা এই “New Normal” চাই না। আমরা ফিরে যেতে চাই আগের সেই স্বাভাবিকে। এমনিতেই আমাদের দেশে বিনোদনের প্রচন্ড অভাব, সেখানে শিশুদের মনস্তত্ত্ব বিকাশের পথ আরো সংকীর্ন হয়ে আসছে। পৃথিবী ফিরে আসুক আমাদের চেনা নিয়মে।
শুভ জন্মদিন আলিনা।
আর ভালো থাকুক তারার সন্তানেরা –
একদিন যারা এসেছিল এই নক্ষত্রের নীচে,
এই সবুজ প্রান্তর আর নেশা ধরা অসীমের পথে
যারা হেঁটেছিল আমাদের পাঁজর থেকে প্রান্তরে।
যারা আকন্ঠ ডুবে ছিল সোনালী অতীতে-
যারা ভুলে গিয়েছিল ভবিষ্যত কথা বলে সময়ের পথে
তারার সন্তানেরা শুন্যে মিলিয়ে যাবার আগে…
দেখে নিও তোমাদের আগেও অনেকে এসেছিল।
ঠিক এভাবেই মিলিয়ে গেছে সবাই –
সময় থেকে প্রান্তরে।
0 Comments